রাজধানীর পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় হাজী মুসা ম্যানশনে লাগা আগুনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চার জনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে তিন জন পুরুষ এবং একজন নারী। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধমান গতকাল শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ভোরে ঘটনাস্থল থেকে সিকিউরিটি গার্ড রাসেল মিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলুফার নামে ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থীকে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া সকাল ১০টার পর ভবনের পাঁচ তলা থেকে আরও দুই জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে একজন ওজিউল্লাহ। অন্য জনের পরিচয় এখনও শনাক্ত হয়নি।
দেবাশীষ বর্ধন আরও বলেন, এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাসহ অনেকেই আহত হয়েছেন। আহত ও দগ্ধ হয়ে অনেকেই মিটফোর্ড এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন।
শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ভোররাত ৩টা ১৮ মিনিটের দিকে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা হাজী মুসা মেনশনে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে। ভবনের নিচতলায় আগুন লাগলে তার ধোঁয়ায় ভবনের দুই তলা থেকে ছয় তলার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বারান্দার গ্রিল কেটে সব ফ্লোরের লোকজনকে উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে আনেন। শুক্রবার সকাল ৯টার পর আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি দল প্রায় ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভাতে সক্ষম হন। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করবে। এরপরই আগুন লাগার কারণ জানা সম্ভব হবে। ফায়ার সার্ভিস তার আইন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।’
মুসা ম্যানশনে অগ্নিকা-ে মারা গেলেন যারা: পুরান ঢাকার আরমানিটোলা হাজী মুসা ম্যানশনের কেমিক্যাল গোডাউন থেকে লাগা আগুনে এখন পর্যন্ত এক নারীসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ২০ জন। তাদের মধ্যে চার জন আইসিইউতে রয়েছেন। ১৬ জন রয়েছেন সাধারণ বেডে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের মধ্যে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়ার পর আহত কয়েকজনকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
আগুনে মারা যাওয়া চার জন হলেন ভবনের কেয়ারটেকার রাসেল মিয়া, ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার, হাজী ম্যানশনের সিকিউরিটি গার্ড ওলিউল্লাহ ব্যাপারী এবং তার আত্মীয় কবির।
আগুনের তীব্রতায় বাইরে বের হতে পারেনি রাসেল: চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ছেলে রাসেল মিয়া আট বছর ধরে হাজী মুসা ম্যানশনের কেয়ারটেকার হিসেবে কর্মরত। ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন তিনি। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার রাতে ঘুমাতে গেলে ভোরে আগুন লাগে ওই ভবনে। আগুনের তীব্রতায় তিনি বাইরে বের হতে পারেনি। পরে আগুনে দগ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা ঘটনাস্থালে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা বলেন, হাজী মুসা ম্যানশনে আগুন লেগেছে বলে আমরা সকালে সংবাদ পাই। এর পর পরই ঘটনাস্থলে আসি। আমরা শুনতে পাই, আগুনের তীব্রতায় রাসেল বাইরে বের হতে পারেনি। ভিতরেই দগ্ধ হয়ে মারা যায় সে।
তারা বলেন, আমরা সবাই ঢাকায় কাজ করি। রাসেলের দুই মেয়ে। এক জনের তিন আরেকটির বয়স দুই বছর। আগুনের খবর পেয়ে চাঁদপুরে থাকা তার স্ত্রী বারবার ফোন দিচ্ছে। কী বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না, কী সান্ত¡না দেবো তাকে। নিহত রাসেলের বাবা চাঁদপুরে একটি টোং দোকান চালান। ভবনের বাসিন্দারা বলেন, আগুন লাগার পর গার্ড রাসেল তিন তলায় এসে আমাদের ঘুম থেকে ওঠান। দরজা নক করে বলে আগুন লেগেছে আপনারা ছাদে যান। একথা বলে সে আবার নিচে চলে যায়। পরে জানতে পারি তার মরদেহ উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। তারা জানান, দহ্য পদার্থ থাকায় আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের পাশাপাশি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো ভবন।
ধোঁয়ায় অচেতন হয়ে পড়েন শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার: হাজী মুসা ম্যানশনের চার তলায় থাকতেন ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতেন তিনি। ধোঁয়ার কারণে অচেতন হয়ে পড়লে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তাকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছালে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাজী মুসা ম্যানশনের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ওলিউল্লাহ ব্যাপারী। ভবনের লাগা আগুনে দগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। কয়েকদিন আগে তার কাছ আসে এক আত্মীয় কবির। শুক্রবার ভোরে লাগা আগুনে তিনিও মারা যান।
উদ্ধার হয় টিয়া পাখি: ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বলেন, হাজী মুসা ম্যানসনে সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অভিযানের শেষ দিকে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি টিয়া পাখির খাঁচা দেখতে পান তারা। এ সময় পাখিটি খাঁচায় ছটফট করছিল। পরে ল্যাডারের মাধ্যমে পাখিটি উদ্ধার করে নিচে নিয়ে আসেন তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ভবনের একটি বৈদ্যুতিক তারের শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। তবে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের ঢাকা মেট্রোর উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন জানান, চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দেবে। তারপরেই আগুন লাগার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানা যাবে।