ফিতরা কী : রমজানের শেষে রোজার পরিশুদ্ধকরণ ও গরিব-দুঃখী মানুষকে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য বাধ্যতামূলক প্রদত্ত দানকে সদকাতুল ফিতর (রোজার সদকা) বা ফিতরা বলা হয়। দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে ফিতরার বিধান জারি করা হয়।
ফিতরা কার ওপর ওয়াজিব : বুখারি শরিফে ফিতরা সম্পর্কীয় ১০টি হাদিস (১৪০৫-১৪১৪) উল্লেখ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: ও আবু সাঈদ খুদরি রা: হাদিসগুলো বর্ণনা করেছেন।
ফিতরা সম্পর্কে ইমামদের মাঝে বেশ মতবিরোধ রয়েছে। উপরের হাদিসগুলো থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, সব মুসলমানের ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, মনিব-ভৃত্য সবাইকে ফিতরা দিতে হবে। ঈদের দিন সকালে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয় তার ওপরও ফিতরা দেয়া ওয়াজিব। বাড়ির প্রধান সবার পক্ষ থেকে ফিতরা দেবেন। তবে কেউ তার নিজেরটা দিলে সমস্যা নেই। কারো পক্ষে কেউ চাইলে দিতে পারবেন। বাড়ির দাস-দাসী ও কর্মচারীর সুনির্দিষ্ট বেতন নির্ধারিত না হলে মালিক তাদের পক্ষে দেবেন।
ইমাম আবু হানিফা রহ: ছাড়া বাকি তিনজন ইমাম ফিতরা প্রদানে নেছাব মানেননি। যার মৌল প্রয়োজন (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) পূরণের ব্যবস্থা আছে অর্থাৎ ঈদের দিনের খাবারের অতিরিক্ত ফিতরা দেয়ার মতো কিছু থাকলে তাকে ফিতরা দিতে হবে। (ইমাম মালেক, শাফেয়ি ও আহমদের মতে, নিজ ও পরিবারের একদিন ও একরাতের খাবারের অতিরিক্ত এক ছা পরিমাণ খাবার থাকলেই ফিতরা ওয়াজিব)। তাদের যুক্তি- দরিদ্ররাও রোজা রাখে এবং তাদেরও রোজার পরিশুদ্ধি প্রয়োজন। ফলে তাদের ফিতরা দিতে হবে। প্রয়োজনে আবার তারা নেবে, যেমন ওশর প্রদানকারী ফসল ওঠার সাথে সাথে নিসাব পরিমাণ হলে তার সম্পদের পবিত্রতা সাধনের লক্ষ্যে ওশর দেয়, যদিও সেই ফসল তার সারা বছরের জন্য যথেষ্ট নয়।
ফিতরার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য : এক. রোজার পরিশুদ্ধকরণ; দুই. দরিদ্রদের ঈদের আনন্দে শরিক করানো। ফলে শিশু-বৃদ্ধ সবার পক্ষ থেকে ফিতরা দিতে হবে। ইমাম আবু হানিফার মতে, ঈদের দিন যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক তাকে ওয়াজিব হিসেবে ফিতরা দিতে হবে।
ফিতরা কখন দিতে হবে : ঈদের নামাজের আগে দিতে হবে এবং ঈদের দু-এক দিন আগেও দেয়া যাবে। সাহাবাদের আমল এমনই ছিল। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে দেবে সেটা হবে তার জন্য পবিত্রতা বিধানকারী। পক্ষান্তরে যে পরে দেবে সেটা হবে সাধারণ দান। ইবনে ওমর রা: ঈদের দু-এক দিন আগে দিতেন। ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতে, রমজানের আগেও দেয়া যায়। আমাদের দেশে সাধারণত রমজানের শেষের দিকে বা ঈদের আগে দেয়ার নিয়ম চালু আছে। ফিতরা না দিলে সে ঋণী থেকে যাবে। ফিতরা আদায় না করলে জাকাত না দেয়ার মতো গুনাহ হবে।
ফিতরা কারা পাবে : যারা জাকাত পাওয়ার অধিকারী ফিতরা পাওয়ার অধিকারীও তারা। জাকাতের ৮টি খাত রয়েছে। ফিতরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। ইবনে ওমর রা: বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ফিতরা ধার্য করেছেন এবং বলেছেন, ‘দরিদ্রদের এদিন তোমরা অভাবশূন্য করে দাও। অমুসলিম নাগরিকদের ফিতরা প্রদান সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা রা:সহ অনেকে অনুমতি দিয়েছেন।
ফিতরা প্রদানে বিতর্ক : ফিতরার পরিমাণ নিয়ে এই মতপার্থক্য সুদূর অতীত থেকে চলে আসছে। রাসূলুল্লাহ সা: ও খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে মক্কা-মদিনার প্রধান খাদ্যশস্য থেকে এক ছা (বর্তমান তিন কেজি ৩০০ গ্রাম) পরিমাণ ফিতরা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা: কোনো একটি নির্ধারণ না করে তাঁর উম্মতের সহজতা বিধানের জন্য তাদের প্রধান খাদ্যশস্য থেকে যেকোনো একটির এক ছা পরিমাণ দেয়ার কথা বলেছেন। নিশ্চয়ই জব, গম, খেজুর, খোরমা, কিশমিশ, পনিরের মূল্য এক ছিল না। এখানে সামর্থ্য ও বিবেচনাবোধে তারা দিয়েছেন। ইবনে ওমর রা: খেজুর দিতেন এবং মদিনায় খেজুরের অভাব দেখা গেলে তিনি একবার জব দিয়েছিলেন।
হজরত আমির মুয়াবিয়া রা:-এর শাসনামলে তিনি হজ বা ওমরাহ উপলক্ষে মদিনায় আসেন এবং মিম্বরে বসে জনগণের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, সিরিয়ার গমের অর্ধ ছা এক ছা খোরমার সমান। লোকেরা সেটি মেনে নিলো।’ আবু সাঈদ খুদরি রা: বলেন, ‘আমি সারা জীবন এক ছা হিসেবেই দিয়ে আসছি। এখানে মনে হচ্ছে- গম মদিনার প্রধান ফসল নয় এবং এটি আমদানিকৃত। গমের দাম অন্যান্য ফসলের প্রায় দ্বিগুণ। আমির মুয়াবিয়া রা: মূল্য বিবেচনা করে বলেছেন, অর্ধ ছা গম দিয়ে দিলেও ফিতরা আদায় হবে। ইমামদের মাঝে এ নিয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। সবার মত হলো- এক ছা হিসেবে ফিতরা দেয়ার। গম ফিতরা দিতে চাইলে ইমাম আবু হানিফা রহ:সহ অনেকের মত, অর্ধ ছা দেয়া যাবে।
আমাদের দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। আমরা ফিতরা হিসেবে চাল দিতে চাইলে এক ছা হিসেবেই দিতে হবে। গমও বলা যায় আমাদের প্রধান খাদ্যশস্যের তালিকায় অন্যতম হিসেবে চলে এসেছে। এখানে গমের চেয়ে চালের দাম বেশি। আমির মুয়াবিয়া রা: গমের দাম বেশি হওয়ার কারণে গম অর্ধ ছা করে দেয়ার কথা বলেছেন। তাকওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার আমরা চাল না গম ফিতরা হিসেবে দেবো।
আর একটি প্রশ্ন রয়েছে, খাদ্যশস্যের পরিবর্তে টাকা দেয়ার বিষয়টি। রাসূলুল্লাহ সা: ও সাহাবায়ে কিরামদের যুগে মুদ্রার প্রচলন ছিল খুবই সীমিত। আর মানুষের পেশা ছিল কৃষিভিত্তিক। উৎপাদিত ফসল প্রদান ছিল সহজ এবং আবাদকারী তাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এ দেশেও আমরা লক্ষ করেছি, গ্রামে অনেক সেবার বিনিময়ে মানুষ দ্রব্য প্রদান করত এবং সেটিই ছিল সহজ। কিন্তু বর্তমানে মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন দ্রব্য বিনিময় প্রথাকে অনেকটা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। তাই খাদ্যশস্য দেয়া ছাড়াও কেউ যদি খাদ্যশস্যের মূল্য নির্ধারণ করে নগদ অর্থ দেন তাহলে তার ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। এই মত সমর্থন করেন ইমাম আবু হানিফা রহ: ও বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতি বছরের মতো এ বছরও ফিতরা নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্ধ ছা গমের (এক কেজি ৬৫০ গ্রাম) বাজার মূল্য ধরে সর্বনিম্ন ফিতরা ৭০ টাকা এবং সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩১০ টাকা নির্ধারণ করেছেন। আপনি নিজে যে মানের চাল খান তার এক ছা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) পরিমাণের বাজার দর হিসাব করে জনপ্রতি ফিতরা দিতে পারেন। ৫০ টাকা কেজি চাল হলে ফিতরা হবে ১৬৫ টাকা। আমার মনে হয় সেটিই উত্তম হবে।
আমার একটি সহজ হিসাব হলো যেখানে মতপার্থক্য রয়েছে সেখানে যেকোনো একটি মত গ্রহণের সুযোগ আছে। আল্লাহপাক আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর দেয়া বিবেক কাজে লাগিয়ে যেকোনো একটি আমল করলে আশা করা যায় আল্লাহ পাক কবুল করবেন। সব ক্ষেত্রে নিয়তই মুখ্য। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন ৭০ টাকা হিসাবে দিলে কোনো সমস্যা আছে কি? আমি বলব, না। একদল বিশেষজ্ঞ আলেমের এটি সম্মিলিত মত। আমি অপছন্দ ও গুনাহ মনে করি, উম্মাহর মতপার্থক্যগত বিষয়ে পরস্পর ঝগড়াঝাটি ও হিংসা-বিদ্বেষকে। আমি এখানে যা কিছু লিখেছি এটি অধ্যয়নগত ফলাফল, আমার নিজের কিছুই নয় এবং কেউ এটাকে ফতোয়া মনে করবেন না। আল্লাহ পাক আমাদের সঠিকটি উপলব্ধি ও ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন। লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ