ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার সুযোগ নিয়েই ফয়সাল মাহমুদ টাকা সরাতে পেরেছিল বলে অভিযোগ করেছে বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। রেলওয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে দেড় কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ইতোমধ্যে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গতকাল রবিবার (৯ মে) এই কমিটি গঠন করা হয় বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন।
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফয়সাল অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। অর্থ ও হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন সে এক কোটি টাকার বেশি সরিয়ে নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে কত টাকা সরিয়ে নিয়েছেন, কীভাবে টাকাগুলো সরিয়ে নিয়েছে সেটি খুঁজে বের করতে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কার্য দিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
ফয়সাল রেলওয়ের পাহাড়তলী অর্থ ও হিসাব শাখায় কর্মরত ছিলেন। ২০১২ সালে জুনিয়র হিসাব কর্মকর্তা হিসেবে তিনি রেলওয়ে যোগদান করেন। টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী কর্মীরা তাকে আটক করে। এই ঘটনার সঙ্গে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, রেলওয়ের অর্থ ও হিসাব শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হয় দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন, না হয় টাকাগুলো সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের পরোক্ষ সমর্থন ছিল। কেননা ফয়সাল প্রতিমাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতার বিল তৈরি করে, তারপর এটি আইবাস সিসটেমে সাবমিট করতো। বিলে কোনও গড়মিল থাকলে সেটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরীক্ষণের সময় ধরা পড়তো। অথচ ফয়সাল গত ৭ মাস ধরে এই কাজটি করে আসলেও সেটি তারা ধরতে পারেনি। আসলে কী তারা ধরতে পারেননি। নাকি তাদের পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে গেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ফয়সাল মাহমুদ আইবাস সিসটেমে বিল তৈরি করে সেটি অ্যাকাউন্টস অফিসে সাবমিট করতেন। ওই অফিস থেকেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অ্যাকাউন্টে বেতন-ভাতা ডিসপাস করা হতো। তাই ফয়সালের পক্ষে আইবাস সিসটেমে ফেইক বিল তৈরি করার পর সাবমিট করার বাইরে টাকা সরিয়ে নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তার মানে এটা নিশ্চিত সে আইবাস সিসটেমে ফেক বিল তৈরি করে সেটি অ্যাকাউন্টস অফিসে সাবমিট করে টাকাগুলো সরিয়ে নিয়েছেন। তাকে সুপারভাইজ করেন রেলওয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের উপ অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি ঠিক মতো বিলগুলো নিরীক্ষণ করেননি। তার দায়িত্ব অবহেলার কারণেই ফয়সাল টাকাগুলো সরিয়ে নিয়েছেন। অথবা টাকাগুলো সরিয়ে নিতে তার পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। মোহাম্মদ শাহজাহানের অনুমতি ছাড়া ফয়সালের পক্ষে কোনও কিছু করা সম্ভব ছিল না। তাকে জানিয়েই সবকিছু করতে হতো। আইবাস সিসটেমের পাসওয়ার্ড দু’জনের কাছেই ছিল।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এই ঘটনার দায়ভার সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনোভাবে এড়াতে পারেন না। কারণ ফয়সালের ওপরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান অর্থ ও হিসাব অধিকর্তাসহ মোট সাতজন কর্মকর্তা আছেন। বিল তৈরি এবং সাবমিট করার পর প্রতিমাসে রেলওয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের উপ অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এইসব কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তারা যদি ভালোভাবে প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতেন অবশ্যই এখানে কোনও অনিয়ম থাকলে ধরা পড়তো।
এ সর্ম্পকে জানতে রেলওয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের উপ অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহানকে একাধিকবার মোবাইল করা হলে তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি। এর আগে রবিবার দুপুর আড়াইটার দিকে তার অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান অর্থ ও হিসাব অধিকর্তা কামরুন্নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাসহ আর্থিক লেনদেন পরিচালনায় গত সেপ্টেম্বর মাসে ইনটেগ্রেটেড বাজেট অ্যান্ড অ্যকাউন্টিং সিসটেম বা আইবাস পদ্ধতি চালু করা হয়। এ পদ্ধতির বিষয়ে ফয়সালসহ কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় রেলওয়ের পক্ষ থেকে। আমরা ধারণা করছি, ওই সময় থেকেই সে টাকা সরিয়ে নেওয়ার শুরু করে। ডিসেম্বর পর্যন্ত টাকা সরিয়ে নেয়। কীভাবে টাকা সরিয়ে নিয়েছে আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। তদন্ত করলে এ বিষয়ে বলা যাবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে আইবাস সিসটেম নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই এ বিষয়ে পুরোপুরি দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানার এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ফয়সাল টাকাগুলো সরিয়েছে।’