যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানেই ঘটে চলেছে ভয়াবহ সব গুলির ঘটনা। দেশজুড়ে বিভিন্ন শহরে বন্দুক হামলা বাড়ছে। এর কারণ নিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দুষছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, যথেষ্ট হয়েছে। তবুও দেশটিতে আগ্নেয়াস্ত্রের চাহিদা কেবলই বাড়ছে।
অন্য যে কোনও সময়ের তুলনায় অনেক বেশি মার্কিনি এখন আগ্নেয়াস্ত্র কিনছেন। এমনকী মহামারীর মধ্যেও বন্দুক বিক্রি বেড়েছে এবং তা বেড়েই যাচ্ছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশক ধরেই আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি বাড়লেও গত বছর থেকে তা আরও বেড়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে মার্কিন সরকার প্রথমবারের মতো অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ করার শর্তারোপের পর আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি গতবছরই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ে উদ্বেগ এবং যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠায় ওই সময় অস্ত্র বিক্রি অনেক বেড়ে যায়।
গতবছর অগাস্টেই আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি এর আগের বছরের মোট অস্ত্র বিক্রির অঙ্ককে ছাড়িয়ে যায়। আর সেপ্টেম্বরে অস্ত্র বিক্রি ভেঙে দিয়েছে আগের সব রেকর্ড।
ডেভিসে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালফোর্নিয়ার অস্ত্র বিশেষজ্ঞ গ্যারেন জে. উইনটেমিউট বলেন, “আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি এতটা বেড়ে যেতে আমরা আগে কখনও দেখিনি। সাধারণত আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি কমে আসে। কিন্তু এখন তা কেবলই বাড়ছে।” যাদের অস্ত্র আছে, তারাই যে কেবল নতুন অস্ত্র কিনছেন, তা নয়। বরং যারা কোনোদিন অস্ত্র ব্যবহার করেননি, তারাও এখন আগ্নেয়াস্ত্র কিনছেন।
নর্থ-ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড ইনজুরি কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টারের হিসাবমতে, গত বছর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মার্কিনি প্রথমবারের মতো বন্দুক কিনেছেন। তাদের মধ্যে অর্ধেকই নারী, এক-পঞ্চমাংশ কৃষ্ণাঙ্গ এবং বাকি এক-পঞ্চমাংশ হিসপানিক।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো রিসার্চ সেন্টারের পরিচালিত জনমত জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিকভাবে ৩৯ শতাংশ পরিবারে বন্দুক রয়েছে। অথচ ২০১৬ সালে ৩২ শতাংশ পরিবারের বন্দুক ছিল।
সাউথ লস অ্যাঞ্জেলস সিটিতে সবচেয়ে বেশি বন্দুক হামলা ঘটে। সেই সিটি কাউন্সিলের প্রতিনিধি মারকুয়িস হ্যারিস-ডাউসন বলেন, “মার্কিনরা এখন একে অন্যের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর সময় যেমন টয়লেট পেপার কেনার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি বন্দুক কেনারও হিড়িক পড়েছে।”
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক বিভাজন এবং অবিশ্বাস বাড়তে থাকার মধ্যে বন্দুক বিক্রি নিয়ে বিতর্ক আবার সামনে চলে এসেছে। সাধারণত নির্বাচনের সময় বন্দুক বিক্রি বাড়ে। কিন্তু এই সময়ে তা বেড়ে যাওয়াটা লক্ষ্যণীয়। এতে আমেরিকানরা একে অন্যকে কী চোখে দেখছে তার একটি ভয়াবহ চিত্রই পাওয়া যাচ্ছে। মানুষজন এখন নিজেদের সুরক্ষা নিয়েই চিন্তিত বেশি।
আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির দোকানে কাজ করা অনেক কর্মী জানিয়েছেন, গত বছর অস্ত্র বিক্রিতে তারা রেকর্ড করেছেন। নানা ধরনের মানুষ এসব অস্ত্র কিনছেন। কর্মীদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, অস্ত্র কিনতে আসা ক্রেতাদের অনেকেই রক্ষণশীল নন। এমনকী তাদের অধিকাংশই কখনও বন্দুক চালাননি এবং চালানো জানেন না। তারাই বেশি দামি অস্ত্র কিনেছেন। এই ক্রেতারা জানিয়েছেন, এ অস্ত্র তারা সঙ্গে রাখবেন না, বাসায় রাখবেন। কারণ, মহামারীতে লকডাউনের সময় নিজেদের নিরাপদ রাখতে তারা অস্ত্র কিনছেন।
নর্থ-ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড ইনজুরি কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টারের হিসাবমতে, ২০২০ সালে ৬.৫ শতাংশ বা ১ কোটি ৭০ লাখ মার্কিনি আগ্নেয়াস্ত্র কিনেছেন। এই হার ২০১৯ সালের তুলনায় ৫.৩ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছেন নর্থ-ইস্টার্নের পাবলিক হেলথ রিসার্চ প্রফেসর ম্যাথিউ মিলার।
তিনি আরও জানান, চলতি বছর অস্ত্রের ক্রেতাদের ৬৩ শতাংশ পুরুষ, ৭৩ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ, ১০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও ১২ শতাংশ হিসপানিক। বন্দুক বিক্রি বেড়ে গেছে মহামারীর সময়ে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বন্দুক ৬৪ শতাংশ বেশি বিক্রি হয়েছে। আর গতবছরের জুন ছিল সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রির মাস।
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক বিক্রির তথ্য রাখা প্রতিষ্ঠান দদ্য ট্রেস’ এর তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারিতে ২৩ লাখ মার্কিনি অস্ত্র কিনেছেন। গত জুলাইয়ের পর থেকে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রির মাস। গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছর প্রথম তিন মাসে অস্ত্র বিক্রির হার ১৮ শতাংশ বেড়েছে।
দ্য ট্রেস এর ডেটা ও গ্রাফিকস এডিটর ড্যানিয়েল নাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অস্ত্র বিক্রির হিসাব রাখে না। তাছাড়া, ফেডারেল ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ ও অস্ত্র বিক্রির পূর্ণ চিত্রও দিতে পারে না। কারণ, অনেকেই গোপনে অস্ত্র বিক্রি করে থাকে। সারা দেশে মোট অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ৪০ কোটি পর্যন্ত হতে পারে।
অস্ত্র বিক্রি বাড়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলাও অনেক বেড়ে গেছে। এসব হামলায় বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। লস অ্যাঞ্জেলসে গত বছর বন্দুক হামলায় হত্যার ঘটনা ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। আর মে’র মাঝামাঝি সময়ে বন্দুক হামলার শিকার হওয়াদের সংখ্যা ৬৮ শতাংশ ও বন্দুক হামলার ঘটনা ৫৬ শতাংশ বেড়েছে।
লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ বিভাগের প্রধান মাইকেল মুর বলেন, এবছর সেখানে নানা হামলার ঘটনায় এপ্রিল পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি বন্দুক জব্দ করা হয়েছে। দিনে গড়ে অন্তত ২৫টি বন্দুক জব্দ করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় চলতি বছর গ্রেপ্তারের হার ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে।