নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ধুঁকছে ফরিদপুরের মধুখালীর কামারখালী ইউনিয়নের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি। জাদুঘর থাকলেও তাতে নেই দেখার তেমন কিছু। ফলে হতাশ হয়ে ফিরে যান দর্শনার্থীরা। ফরিদপুরের রউফনগর গ্রামে অবস্থিত এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি। এখানে বড় একটি কক্ষের ভেতরে রয়েছে মুন্সী আব্দুর রউফের ব্যবহার্য চিনামাটির দুটি তৈজসপত্র, বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দুটি পোস্টার আর রয়েছে কিছু বই-পুস্তক। স্মৃতি জাদুঘর বলতে শুধুমাত্র এতোটুকুই। সেখানে যাওয়ার সড়কটি নদীভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে। করুণ দশা শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফের বাড়িটিও। শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি রয়েছে ফরিদপুরের মধুখালীর রউফনগর গ্রামে (পুরোনো নাম সালামতপুর)। এ গ্রামেই ১৯৪৩ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন মুন্সী আব্দুর রউফ।
মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ মে তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) বাহিনীতে যোগ দেন। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল রাঙ্গামাটির মহালছড়ি নৌপথে বুড়িঘাট এলাকায় পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের সময় শহীদ হন আব্দুর রউফ। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ২০০৭ সালের ১৭ নভেম্বর। জেলা পরিষদের ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় ৩ হাজার ৫৩৫ বর্গফুটের এ স্থাপনাটি। ২০০৮ সালের ২৮ মে উদ্বোধন করা হয়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এ গ্রন্থাগারে মোট পাঁচ হাজার ১৮৮টি বই রয়েছে। এসব বইয়ের মধ্যে বেশিরভাগ বই-ই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত। পাঠকদের বসার জন্য পাঁচটি টেবিল ও ৪০টি চেয়ার রয়েছে। এতো বড় একটি প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণে জনবল রয়েছে মাত্র দুইজন। বীরশ্রেষ্ঠের চাচাতো ভাই মুন্সী সাইদুর রহমান (৩৩) জানান, দর্শনার্থীরা প্রায়ই প্রশ্ন করেন, গ্রন্থাগার রয়েছে কিন্তু জাদুঘর কোথায়? ভেতরে ঘুরে দেখার মতো কিছুই নেই। তাদের এরকম প্রশ্নের উত্তরে চুপ থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
এলাকাবাসী জানান, কোনো জাতীয় দিবস, এমনকি বীরশ্রেষ্ঠের মৃত্যুবার্ষিকীও এখানে সরকারি উদ্যোগে পালিত হয় না। মৃত্যুদিবসটি পালিত হয় পরিবারের উদ্যোগে। এতে অবশ্য জেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের অনুদান থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রন্থাগারে মাত্র দুটি জাতীয় পত্রিকা রাখা হয়। তা পড়তে দু-চারজন পাঠক প্রতিদিন আসেন। তাদের একজন স্থানীয় বাসিন্দা আওয়াল মোল্লা (৬৭)। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তার মতো হাতেগোনা কয়েকজন আসেন পত্রিকা পড়তে। অথচ আগে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও আসত। যাতায়াতের সড়কটি ঠিক হলে গ্রন্থাগারে পাঠক বাড়বে। কামারখালী বাজার থেকে রউফনগর গ্রামে গেছে সড়কটি। ১০ বছর ধরে সড়কটির গন্ধখালী এলাকায় মধুমতী নদীর ভাঙন চলছে। ভাঙা প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশটি পায়ে হেঁটেও পার হওয়া কঠিন। গন্ধখালী এলাকার বাসিন্দা জহুরুল মোল্লা (৭৮) বলেন, ‘দেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠের একজন মুন্সী আব্দুর রউফ। তার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটির এমন অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’
ওই গ্রামের বাসিন্দা মতিয়ার মোল্লা বলেন, ‘সড়কটির বেশিরভাগই বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান ভেঙে যাওয়া অংশে বালুর বস্তা দেয়ার কারণে তার ওপর দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারেন কোনোমতে। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক দর্শনার্থীকে এ স্থান থেকে ফিরে যেতে হচ্ছে।’ জাহাঙ্গীর হোসেন নামের আরেকজন বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের জন্ম আমাদের এলাকায় হওয়ায় আমরা গর্ববোধ করতাম। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর এখানে হওয়ায় আমরা ভেবেছিলাম এলাকার অনেক উন্নয়ন হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি।’
কামারখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান বিশ্বাস বাবু বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ার সড়কটির গন্ধখালীসহ কয়েক স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর আগে বিভন্ন সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ভাঙনরোধে জিওব্যাগ ফেলেছে। কিন্তু প্রতি বছরই নতুন নতুন জায়গায় ভাঙন দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে কথা হয় মধুখালী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. মুরাদুজ্জামান মুরাদের সঙ্গে। তিন বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ার রাস্তাটি সংস্কারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ চেয়ারম্যান আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের খাস জমি দেয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। ভাঙন এলাকায় জিও ব্যাগ (বালুভর্তি) ফেলা হয়েছে। এছাড়া মধুমতির ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারেও কথাবার্তা চলছে।’
মধুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হক বকু বলেন, ‘নদী ভাঙনের সমস্যা নিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান নিজে উদ্যোগ গ্রহণ নিয়ে বেশ কয়েকবার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। সে মোতাবেক কয়েক দফা কাজও হয়েছে। তবে স্থায়ী সমাধান হয়নি।’এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) ফরিদপুর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমি উপজেলা প্রকৌশলীকে নিয়ে ওই সড়ক দেখতে গিয়েছিলাম। রাস্তাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর পাড় বাঁধা না হলে রাস্তা নির্মাণ করা যাচ্ছে না। নদীর পাড় বেঁধে দিলে আমরা দ্রুত রাস্তা করে দেব।’ ফরিদপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগ ফেলা হবে। দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পাশাপাশি নদীতীরের সাত কিলোমিটারে বাঁধ দিতে ৪৮১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।’