সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৭ পূর্বাহ্ন

বাবার মর্যাদা

মুহাম্মদ মিযানুর রহমান:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৯ জুন, ২০২১

‘বাবা’ শব্দটি মনে হলেই প্রত্যেক সন্তানের চোখে ভেসে ওঠে পরম ভরসা ও আত্মবিশ্বাসের ছবি। বড় মমতা, সাহসের প্রিয় এক মুখ। সন্তানের কাছে প্রত্যেক বাবা অপার্থিব এক ভালোবাসা। ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে; বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না; জানালার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা; মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না; আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।’ শিল্পীর গাওয়া এ গানটি সন্তানদের মনে করিয়ে দেয় বাবা আসলে কী? মূলত বাবা হলেন সেই বটবৃক্ষ, যার ছায়াতলে সন্তান সবচেয়ে নিরাপদ থাকে। বাবা শব্দটি দায়িত্ব ও ভালোবাসায় ঘেরা। বাবা হলেন শ্রদ্ধা, ভয়, উৎসাহ, নির্দেশনা ও নির্ভরতার চূড়ান্ত ঠিকানা। যার হাত ধরে সন্তানরা পৃথিবীর সব দুর্গমপথ হেঁটে যায় স্বপ্নসুখে। বাবা নামটিই কেমন ভারী ভারী! বাবা মায়ের মতো নন। বাইরে বেশি থাকেন। কঠিন চেহারা, শক্ত চোয়াল আর সহজেও হাসেন না। আর এই বাবাকে কোনো না কোনো দিন চিনে ফেলে সন্তান। বাইরে তিনি যতটাই কঠিন, ভেতরে ততটাই কোমল। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজের হাসিমুখকে উৎসর্গ করে দেন এই বাবা। তাই তো বাবার জীবনে ঘটে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, দুর্ব্যবহার, অসৎ আচরণও। সন্তানের সুখের জন্য সওদাগর হয়ে যান। বাবা ছোটাছুটি করেন নিরন্তর। সন্তানের জীবনে যেন কষ্ট-ক্লেশের কোনো স্পর্শ না লাগে, এ জন্য বাবা হন অতন্দ্র প্রহরী। আমার বাবার বেলায়ও তাই। শৈশবে দারুণ অসুস্থতার সময়ে জীবনের মায়া ছেড়ে বিশাল ছায়া হয়েছেন সন্তানকে বাঁচানোর তাগিদে। সামান্য ভুলে দিতে হয়েছে শাণিত পাতের খেসারত। পরিবার ছাড়া বাইরের খাবার খেতে খুব অপছন্দ করেন। আবার পরিবার, সন্তানের শত ভুলের পর দিন শেষে মুচকি হেসে সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরতে শুধু বাবাই পারেন। ‘বাবার আদর্শেই আমরা চলি। বাবা ছিলেন বটবৃক্ষ, এখনো তাই। এ অনুভূতিই আমাকে একটা নিরাপত্তা আর নির্ভরতার বোধ দেয়। দেয় আত্মবিশ্বাস।’ ‘বাবা’ শব্দটি যেন এক পৃথিবীর সমান। একজন বাবা তার সন্তানদের শুধু ভালোবাসা নয়, তার শেষ সম্বলটুকু উজাড় করে দিতেও দু’বার চিন্তা করেন না। কারণ তার কাছে সন্তানের চেয়ে দামি আর কিছু নেই।
কিন্তু সেই সন্তানদের কেউ যদি বাবাকেই ভুলে যায়? বাবাকে ঘিরে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভয়, চাপা অভিমান কত কিছুই না থাকে। হয়তো জীবনে চলার পথে বাবার অমতে কোনো কাজ করেছিলাম, কোনো ভুল করেছিলাম, সে জন্য আজো তার কাছে ক্ষমা চাওয়া বা সরি বলা হয়নি- এমন নানা অনুভূতি ও অব্যক্ত কথা সবারই আছে। কিন্তু সেগুলো কি বাবাকে আমরা জানাতে পেরেছি- না। তবুও দুনিয়ার প্রত্যেক বাবা আপন ছেলেকে ঘিরেই তার স্বপ্নের পৃথিবী, কল্পনার পাতায় পাতায় আঁকেন শত সুখের আল্পনায়। ছেলে ভালো রেজাল্ট করবে, সমাজে মাথা উঁচু করে মানুষের সেবা করবে, ভালো কোনো পেশায় নিজেকে নিয়জিত করবে; এমন কত শত স্বপ্ন দেখেন বাবারা। দ্বীনের পথে চলবে সন্তান, আমার ইন্তেকালের পর সন্তান আমার জানাজা নামাজে ইমামতি করবে; এমন অনেক স্বপ্ন দেখেন বাবারা। কোনো দিবসকে ঘিরে নয়, বরং ইসলাম মা-বাবার প্রতি সবসময় সুন্দর আচরণের কথা বলে। এ জন্য মা-বাবার আনুগত্যের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন; তবে তাদের ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সাথে বলো শিষ্টাচারপূর্ণ কথা। (সূরা বনি ইসরাইল-২৩) এভাবে পবিত্র কুরআনের ১৫ জায়গায় মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। অন্য দিকে রাসূলুল্লাহ সা: বাবার মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হন; আবার বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’ সে কারণেই ইসলাম মা-বাবার সাথে অন্যায় আচরণ করাকে বড় গুনাহের কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মা-বাবার মর্যাদা কত বড় তার প্রমাণে রাসূলুল্লাহ সা:-এর রয়েছে অনেক বড় একটি হাদিস। হাদিসটি হলো- হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- ‘একবার রাসূলুল্লাহ সা: মিম্বরের প্রথম ধাপে ওঠে বললেন, ‘আমিন; দ্বিতীয় ধাপে ওঠে বললেন, আমিন; তৃতীয় ধাপে ওঠে বললেন, আমিন।’ সাহাবায়ে কেরাম বিশ্বনবীর আমিন বলার কারণ জানতে চাইলেন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘এইমাত্র জিবরাইল আ: আমাকে জানালেন, যে ব্যক্তি রমজান পেল কিন্তু তার গুনাহ মাফ হয়নি, সে ধ্বংস হোক; আমি বললাম আমিন। তারপর জিবরাইল আ: বলল, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যার সামনে আমার নাম উচ্চারণ করা হলো কিন্তু সে দরুদ পড়ল না, আমি বললাম আমিন। তার পর জিবরাইল আ: বলল, সে ধ্বংস হোক, যে বাবা-মা উভয়কে পেল অথবা একজনকে পেল কিন্তু তারা তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না। আমি বললাম আমিন।’ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেন, ‘বার্ধক্যে বাবা-মা দুর্বল হয়ে পড়ে; রোগে-শোকে অসহায় হয়ে পড়ে, সে অবস্থায় যে সন্তান মা-বাবার খেদমত তথা সেবাযত্ন না করে তাদের জন্য এ ধ্বংস। যে ব্যাপারে বিশ্বনবী আমিন বলেছেন।’ অথচ বিশ্বনবী ছিলেন উম্মতের জন্য রহমদিল। সবসময় উম্মতের জন্য আল্লাহর কাছে কল্যাণের আবেদন করতেন। অথচ মা-বাবার অবমূল্যায়ন করায় বিশ্বনবী তাদের ধ্বংসের ব্যাপারে আমিন বলেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)
রাসূল সা: একদিন তার সাহাবিদের সাথে আলাপ করছিলেন। এমন সময় এক বৃদ্ধা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। নবীজী সা: বৃদ্ধাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং তার গায়ের চাদরটি মাটিতে বিছিয়ে তাকে বসতে দিলেন। তার পর অত্যন্ত দরদ দিয়ে বৃদ্ধার সাথে কথাবার্তা বললেন। বৃদ্ধা চলে গেলে সাহাবিরা বিস্মিত হয়ে নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে এই মহিলা যার জন্য আপনার এত দরদ, এত আন্তরিকতা?’ নবীজী উত্তরে বললেন, ‘তিনি আমার দুধমা হালিমা।’ তিনি বৃদ্ধ দুধমায়ের প্রতি এতটাই নমনীয় ছিলেন। এটিই ইসলামের শিক্ষা। লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com