রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
খেলাধুলার মাধ্যমে মাদককে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে-মাফরুজা সুলতানা মাইলস্টোন কলেজে নবম শ্রেণির বালিকাদের অংশগ্রহণে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুপারিশ  ‘বিবেচনায় রয়েছে’: বদিউল আলম ১৬ বছর বঞ্চিতদের এবার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বইমেলয় স্টল বরাদ্দের দাবি ইসির অগাধ ক্ষমতা থাকলেও প্রয়োগে সমস্যা ছিল: বদিউল আলম আমাদের শিক্ষা কর্মসংস্থান খোঁজার মানুষ তৈরি করছে, যা ত্রুটিপূর্ণ: প্রধান উপদেষ্টা সেন্টমার্টিন: ‘স্থানীয়দের জীবিকা বনাম পরিবেশ রক্ষা’ আ. লীগ-জাপা নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাবিতে কফিন মিছিল ১৫ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে সময় লাগবে: মির্জা ফখরুল

কোরবানির আহকাম ও মাসায়েল

মুফতি জাকারিয়া মাসউদ:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৭ জুলাই, ২০২১

প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে (সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের অতিরিক্ত) নেসাব পরিমাণ সম্পদের (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা রুপা কিংবা তার সমমূল্যের কোনো জিনিসের বা নগদ অর্থের) মালিক হবে, আর তার এ পরিমাণ ঋণ না থাকে, যা পরিশোধ করলে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে কমে যাবে, এমন ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব। জাকাত ও কোরবানির নেসাবের মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। জাকাতের নেসাবের সারা বছর মালিক থাকতে হয় কিন্তু কোরবানির নেসাবের কোরবানির এই তিন দিনের মধ্যে মালিক হলেই তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়। কোরবানির নেসাবের মধ্যে কী কী জিনিসকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গণ্য করা হবে তা উল্লেখ করা হলো : প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলতে, যেসব বস্তু ইজ্জত-সম্মান ও জীবন রক্ষার্থে অপরিহার্য পরিমাণ সম্পদের অতিরিক্ত, তাকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলা হয়। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলঙ্কার। বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না, এমন জমি, অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য, অপ্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র, যেমন বড় বড় ডেগ, উন্নতমানের বিছানা, গদি, শামিয়ানা ইত্যাদি। এসবের মূল্য কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, ৫/২৯২)।
আবু হুরায়রাহ রা:থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা:বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৩)। ইলমে ফিকহের গুরুত্ববহ কিতাব বাদায়েউস সানায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে, আর ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলির মধ্য থেকে সামর্থ্যবান হওয়া একটি শর্ত। কারণ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে সামর্থ্য রাখে সে যেন কোরবানি করে। বিশ^নবী সা: সামর্থ্য অর্থাৎ সম্পদশালী হওয়াকে কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য শর্ত হিসাবে উল্লেখ করেছেন (বাদায়েউস সানায়ে, ৫/৬৪)। অনুরূপ ফতোয়ার অন্যতম কিতাব যেটি উলামাদের কাছে যা ফতোয়ায়ে শামী নামে পরিচিত সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আর কোরবানি ওয়াজিব হবে যদি সে ২০০ দেরহাম অর্থাৎ সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মালিক হয় অথবা তার সমমূল্যের কোনো আসবাবপত্রের মালিক হয়। তার বসবাস করার ঘর, ব্যবহৃত পোশাক ও আসবাব ব্যতীত। কোরবানি করা পর্যন্ত অর্থাৎ জিলহজের ১০ তারিখ থেকে নিয়ে ১২ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত (রদ্দূল মুহতার,৬/৩১২)।
জমির মূল্য নেসাবের অন্তর্ভুক্ত কি না? একটি প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খায় বিভিন্ন সময় আমরা জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয়ে থাকি যে, জমির মূল্য নেসাবের মধ্যে হিসাবযোগ্য হবে কি না? এর জবাব হলো, জমি থেকে উৎপাদিত ফসল প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকলে, তার মূল্য নেসাবের মধ্যে হিসাবযোগ্য। নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি থাকলে, তার বর্তমান বাজার মূল্যও নেসাবের মধ্যে হিসেবযোগ্য (হিন্দিয়া, ৫/২৯২)।
কোরবানির পশুতে আকিকার হুকুম : নানা আলেমের নানা মতের ভিড়ে সাধারণ মুসলিম দিশেহারা এমন মন্তব্য বহু মানুষের মুখে শোনো যায়। তেমনই একটি মাসয়ালা অনেকের মনের ধারণা হলো কোরবানির পশুতে অন্য কোনো নিয়ত চলে না। বিষয়টি এমন নয় বরং কোরবানির সাথে আকিকা নিঃসন্দেহে সহিহ হবে। উভয়টির জন্য হাদিসে একই ধরনের প্রাণীর উল্লেখ রয়েছে। আর কোরবানির ও আকিকার জন্য হাদিস শরিফে একই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন এখানে বুখারি শরিফের একটি হাদিস দেখুন সেখানে আকিকার জন্য ইহরাকুদ্দম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। মুস্তাদরাকে হাকেম, তিরমিজি বায়হাকিসহ অনেক কিতাবে কোরবানির জন্য ঠিক এই ইহরাকুদ্দম শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। যেমনটি হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, মুহাম্মদ ইবনু শিরিন থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমাদের হাদিস বর্ণনা করেছেন সালমান বিন আমির রা:। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সা:কে বলতে শুনেছি যে, সন্তানের সঙ্গে ‘আকিকা সম্পর্কিত। তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত (অর্থাৎ ‘আকিকার জন্তু জবেহ্) করো এবং তার অশূচি (চুল, নখ ইত্যাদি) দূর করে দাও (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৫৪৭১)। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, আয়শা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, কোরবানির দিন মানুষ যে কাজ করে তার মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় হচ্ছে রক্ত প্রবাহিত করা (কোরবানি করা)। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস নম্বর : ৭৫২৩) আবার আবু দাউদ শরিফের একটি হাদিসে কোরবানির জন্য ‘নাসাক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিক আবু দাউদ শরিফেরই অন্য একটি হাদিসে আকিকার জন্য ওই ‘নাসাক’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কী স্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণিত হয় না যে, কোরবানি ও আকিকা একই ধরনের ইবাদত এবং এ দুটি একসঙ্গে একই পশু দ্বারা জায়েজ হবে। ফতোয়ায়ে হিন্দিয়ার মধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি সবাই কুরবতের নিয়ত করে কোরবানি বা অন্য কিছু তাহলে সবার পক্ষ থেকেই যথেষ্ট হয়ে যাবে। এমনিভাবে কেউ যদি তার অতীতে ভূমিষ্ঠ সন্তানের আকিকা করতে চায় তাও সহিহ হবে (ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩০৪)।
গরু বা উট অথবা এ ধরনের পশুতে সাত শরিকে কোরবানি করার হুকুম : আমাদের অনুসরণের মাপকাঠি হলো সাহাবায়ে কেরাম রা:। সুতরাং তাদের আমল যদি এমন থাকে তাহলে তো এর চেয়ে বড় কোনো দলিল আর আমাদের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং দেখে আসি এ ব্যাপারে তাদের আমল কী ছিল? সাহাবায়ে কেরাম রা:-এর সাথে সাত ভাগে কোরবানি করেছেন। প্রথম দলিল : হজরত জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে হজ সমাপন করি। আমরা সাত শরিকে একটি করে উট বা গরু কোরবানি করেছি (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩০৭৮)। দ্বিতীয় দলিল : হজরত ইব্ন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ সা:-এর সঙ্গে সফরে ছিলাম, তখন কোরবানির সময় উপস্থিত হলে আমরা একটি উটে ১০ জন শরিক হলাম, আর একটি গাভীতে সাতজন। (তবে উটে দশজনের শরিক হওয়ার বিধানটি অন্য হাদিস দ্বারা মানসুখ তথা রহিত হয়ে গেছে।) (সুনানে আন-নাসায়ি, হাদিস নং ৪৩৯২)। তৃতীয় দলিল : অনেকে বলেন সাত ভাগে কোরবানি হজের সাথে অথবা সফরের সাথে খাস, যা একান্তই মুর্খতা ও অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। তার পরও আমরা এ পর্যায়ে এমন একটি সহিহ হাদিস উল্লেখ করছি, যা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সাত ভাগে কোরবানির বিষয়টি হজের অথবা সফরের সাথে খাস নয়।
হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, সব কোরবানির ক্ষেত্রে গরুতে সাতজনের পক্ষ থেকে এবং উটে সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে (আল মুজামুল আওসাত লিততবারানী,৬/১৮২, হাদিস নম্বর : ৬১২৮ শায়খ আলবানীও সহিহু জামিইস সগীরে উক্ত হাদিসকে সহিহ বলেছেন। (দেখুন সহিহু জামিইস সগীর, হাদিস নম্বর : ২৮৯০)।
সাতজনের কম শরিক হওয়ার বিধান : অনেকে আবার মনে করেন, সাতজনের কম হলে বড় পশুতে কোরবানি হয় না। এ জন্য তারা যেকোনোভাবে কষ্ট করে সাতটি নামই পূরণ করার চেষ্টা করে। এটি একটি ভুল ধারণা। গরু বা এ ধরনের বড় পশুতে এক থেকে নিয়ে সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারেন। তাতে সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা গ্রহণযোগ্য হবে। জোড় বেজোড় বা কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা মানার প্রয়োজন নেই। মালিকুল ওলামা আল্লামা কাসানি রহ: বলেন : একটি উট বা গরুতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যদি সাতের কম হয়, যেমন- দু’জন অথবা তিনজন অথবা চারজন অথবা পাঁচজন কিংবা ছয়জন একটি উট অথবা গরুতে অংশগ্রহণ করে, তবে তা জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
অল্প কিছু গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো এর চেয়ে ভিন্ন কোনো মাসয়ালা জানার প্রয়োজন হলে নিকটতম নির্ভরযোগ্য আলেমের শরণাপন্ন হওয়ার অনুরোধ রইল। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পূর্ণাঙ্গরূপে কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক : সাংবাদিক, ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com