১১তম সামাজিক ব্যবসা দিবস অনুষ্ঠিত
মহামারী-পূর্ব অর্থনৈতিক কাঠামোতে ‘আর ফিরে যেতে চাই না’ থিমে ১১তম সামাজিক ব্যবসা দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীর ১১০টি দেশের ২ হাজার ৩০ জন ব্যক্তি এই অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। প্রতিদিন ১২ হাজারের অধিক মানুষ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফরমে এই অনুষ্ঠান সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দর্শকের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ইউনূস সেন্টারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। গত ২৮শে জুন থেকে ২রা জুলাই ২০২১ পর্যন্ত নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও ইউনূস সেন্টার এর পৃষ্ঠপোষকতায় ভার্চুয়াল প্লাটফরমে এ সামাজিক ব্যবসা দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মী এবং নোবেল বিজয়ীদের নিয়ে ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন অ্যাজ গ্লোবাল কমন গুড’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে বিশ্বব্যাপী পেটেন্টমুক্ত রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। এ বছরের সামাজিক ব্যবসা দিবস মূলত ভার্চুয়াল প্লাটফরমে অনুষ্ঠিত হলেও কাম্পালা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কাম্পালা, উগান্ডা এবং জিম্বাবুয়ে ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়, হারারে, জিম্বাবুয়েতে স্থানীয়ভাবে এর গ্রাউন্ড সেশনসমূহ অনুষ্ঠিত হয় যেহেতু বৈশ্বিক বিষয়বস্তুর পাশাপাশি পূর্ব আফ্রিকার উপরও এ বছরের দিবসটি স্থানীয়ভাবে আলোকপাত করে। শূন্য নীট কার্বন নিঃসরণ, দারিদ্র দূরীকরণে শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ এবং সকলের জন্য উদ্যোক্তা প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে শূন্য বেকারত্বের একটি “তিন শূন্য”র পৃথিবী গড়ে তোলার মাধ্যমে মহামারী-পূর্ব পৃথিবীতে “আর ফিরে যেতে চাই না”- এই ছিল এ বছরের সামাজিক ব্যবসা দিবসের মূল বিষয়বস্তু।
অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তার সঙ্গে ছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী টিমোর লেস্টের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোরতা, টঘঅওউঝ-এর নির্বাহী পরিচালক উইনি বিয়ানিমা, এবং ড্যানোন এর প্রাক্তন প্রধান নির্বাহী ইম্যানুয়েল ফেবার। লুক্সেমবার্গের গ্র্যান্ড ডাচেস মহামান্য মারিয়া টেরেসা বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেক্টারগণও অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মতামত বিনিময় করেন।
পাঁচ দিনের এই আয়োজনের মধ্যে ছিল ১৬টি প্লেনারী সেশন ও ৮টি অ্যাকাডেমিয়া ফোরাম। বিভিন্ন অঙ্গন ও শিল্প থেকে আসা ১৬২ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কীভাবে মহামারীকালে ও মহামারী-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বৈশ্বিক ও স্থানীয় সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায় সে বিষয়ে তাঁদের সুচিন্তিত বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে আরো ছিল ১৫টি কান্ট্রি ফোরাম যেখানে সামাজিক ব্যবসা পরিচালনাকারী ও সামাজিক ব্যবসায়ে আগ্রহী ব্যক্তিরা সম্মিলিতভাবে তাঁদের স্ব-স্ব এলাকার বিভিন্ন সমস্যা এবং সেগুলোর সামাজিক ব্যবসা সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। চীন, অষ্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, উত্তর আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপ, নেপাল, ভারত, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য কান্ট্রি/আঞ্চলিক ফোরামগুলি অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে আয়োজিত রিপোর্টিং সেশনে তাঁদের আলোচনা ও সিদ্ধান্তগুলি সকলের সামনে তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের মূল সেশনগুলিতে উল্লেখযোগ্য বক্তাদের মধ্যে আরো ছিলেন ইনফোসিস এর প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূরতি, অ্যাভন এর প্রাক্তন প্রধান ও গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রিয়া জাং, সীড হেলথ এর প্রধান নির্বাহী ড. ভ্যানেসা কেরী, চায়না কন্সট্রাকশন ব্যাংকের চেয়ারম্যান টিয়ান গুয়োলি, সোশ্যাল এন্ট্রারপ্রাইজ ইউকে’র প্রধান নির্বাহী পিটার হলব্রুক, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী মারিনা মাহাথির, এবং অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী শ্যারন স্টোন।
সম্মেলনের ৩য় দিন থেকে আয়োজিত হয় সামাজিক ব্যবসা অ্যাকাডেমিয়া ফোরাম, যেখানে পৃথিবীর ৩৪টি দেশের ৯২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক বিশেষজ্ঞগণ সামাজিক ব্যবসা অ্যাকাডেমিক কারিক্যুলাম ও কোর্স পরিকল্পনা এবং সামাজিক ব্যবসা গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেন।
এ বছরের সামাজিক ব্যবসা দিবসের অন্যতম আকর্ষণ ছিল নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক “থ্রি জিরো ক্লাব” (৩তঊজঙ ঈষঁন) উদ্বোধন যার লক্ষ্য কিশোর ও তরুণদেরকে “তিন শূন্য”র পৃথিবী গড়ে তোলায় উজ্জীবিত ও সম্পৃক্ত করা। একটি থ্রি জিরো ক্লাব ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে সমমনা, সমবয়সী ৫ জনের একটি স্ব-গঠিত ক্লাব যেখানে ক্লাব সদস্যরা তাদের তারুণ্যপূর্ণ সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করে এ সময়ের বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একটি “তিন শূন্য”র পৃথিবী গড়ে তুলতে তাদের স্ব-নির্ধারিত মিশন নিয়ে কাজ করবে। অনুষ্ঠানে এই ক্লাবের উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্ম-পরিধি বিস্তারিত উপস্থাপন করা হয় এবং এরপর কীভাবে এই থ্রি জিরো ক্লাবসমূহের একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায়, কীভাবে কম বয়সী ছেলে-মেয়েদেরকে এই ক্লাবের লক্ষ্যগুলির সাথে পরিচিত করা যায় এবং তাদের সৃষ্টিশীলতাকে কীভাবে ক্লাবের লক্ষ্য অর্জনে চালিত করা যায় তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়।
পরের সেশনগুলি ছিল কোভিড সংকট মোকাবেলা ও সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলা ইত্যাদি সংক্রান্ত। “গ্লোবাল ফার্মা সামাজিক ব্যবসা: কীভাবে সামাজিক ব্যবসা স্বাস্থ্য খাতে বৈশ্বিক অসমতা দূর করতে পারে,” “করোনার প্রেক্ষাপটে ও করোনা-পরবর্তী সময়ে সামাজিক ব্যবসা হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা,” “বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসা অভিজ্ঞতা” শীর্ষক সেশনগুলিতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিক ব্যবসা পরিচালনাকারী ব্যক্তিত্বগণ মাঠ পর্যায়ে তাঁদের অনবদ্য কাজগুলি নিয়ে আলোচনায় মিলিত হন। অন্য সেশনগুলি ছিল “গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তোলা,” “আফ্রিকাতে সামাজিক ব্যবসার বিকাশ,” এবং “গ্রামীণ আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারী উদ্যোক্তা কর্মসূচি” যেখানে গ্রামীণ আমেরিকার প্রধান নির্বাহী অ্যান্ড্রিয়া জাং এবং সংস্থাটির বিভাগীয় প্রেসিডেন্ট অ্যাথেলিয়া মেন্ডেজ তাঁদের “এলিভেটিং ব্লাক উইমেন এনট্রাপ্রির্নিয়া” কর্মসূচির লক্ষ্য ও অগ্রগতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
আন্তর্জাতিক মানবাাধিকার কর্মীদের সহযোগে আয়োজিত “বৈশ্বিক সর্বসাধারণের পণ্য হিসেবে টিকা” শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লেনারীতে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী এবং নোবেল লরিয়েটগণ কোভিড-১৯ এর টিকাকে একটি বৈশ্বিক সর্বসাধারণের পণ্যে পরিণত করতে প্রফেসর ইউনূসের বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ ও প্রচারণার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।
পৃথিবীর মাত্র ০.৩% মানুষকে এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর টিকা দেয়া হয়েছে অথচ উন্নত দেশগুলি তাদের নিজেদের জন্য টিকার পাহাড় গড়ে তুলছে। মহামারী শুরুর পর থেকে “বিগ ফার্মা বিলিয়নিয়ারের” সংখ্যা বেড়ে চলেছে। টিকা উৎপাদনে ব্যয়িত প্রতি ১ মার্কিন ডলারের বিপরীতে টিকা বিতরণে ৫ ডলার করে খরচ করতে হচ্ছে। টঘঅওউঝ-এর নির্বাহী পরিচালক উইনি বিয়ানিমা বলেন যে, একটি কোভ্যাক্স টিকার গড় মূল্য ১০ ডলার কিন্তু এর প্রকৃত উৎপাদন খরচ ৬০ সেন্ট, আর এ কারণে যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয়ভাবে এই টিকার উৎপাদন খুবই জরুরী। সেশনের বিশিষ্ট বক্তাগণ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন যে, এই মহামারী কতদিন স্থায়ী হবে তা “কোনো বৈজ্ঞানিক সমস্যা নয় – সমস্যাটি টিকার একচেটিয়ার, টিকা বর্ণবাদের।” প্রফেসর ইউনূস আরো বলেন যে, “মহামারী মোকাবেলায় আমি এখন পর্যন্ত কোনো একক বৈশ্বিক পরিকল্পনা দেখছি না।” তিনি সকলের প্রতি তাঁদের নিজ নিজ সরকার, প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষকে একটি সার্বিক সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য জোরালো আবেদন করতে আহ্বান জানান।
সমাপনী সেশনে বক্তব্য রাখেন অ্যাম্বাসেডর ডো ইয়ং-শিম, কো-চেয়ার, জাতি সংঘ এসডিজি অ্যাডভোকেটস অ্যালামনাই এবং অ্যাম্বাসেডর, ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম ট্রাভেল কাউন্সিল, ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা কেট রবার্টসন, গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, স্কটল্যান্ডের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক পামেলা জিলিস প্রমূখ। আরো বক্তব্য রাখেন ইউনূস সেন্টারসমূহ, ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস ও গ্রামীণ ক্রিয়েটিভ ল্যাবের পরিচালকবৃন্দ এবং বিভিন্ন অংশীদার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রতিনিধিগণ। তাঁরা তাঁদের বক্তব্যে প্রফেসর ইউনূসের “তিন শূন্য”র রূপকল্প ভিত্তিক একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে নতুন পথ নির্মাণে বিশ্বব্যাপী তরুণ উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ও তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।