ইকুয়েডরে ম্যানগ্রোভ কেটে চিংড়ি চাষ করার প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুলাই আয়োজিত সমাবেশে মৃত্যু হয় একজন অংশগ্রহণকারীর। সেই থেকে তাঁর স্মরণে ২৬ জুলাই দিনটি বেসরকারিভাবে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইউনেসকোর আহ্বানে ২০১৫ সাল থেকে এই দিনটিকে ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এর লক্ষ্য ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। অনন্য, বিশেষ ও দুর্বল বাস্তুসংস্থানের ম্যানগ্রোভের টেকসই পরিচালনা, সংরক্ষণ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য।
বিশ্বের মধ্যে একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাকৃতিক নানা কারণ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ফলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন বেশ চাপে আছে। সা¤প্রতিক একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে নোনার মাত্রা বেড়েছে। স্বাদু ও নোনা পানির একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় যে প্রতিবেশব্যবস্থা গড়ে ওঠে তাকেই ম্যানগ্রোভ ইকোলজি (বাস্তুতন্ত্র) বলা হয়। এখানকার পানিকে ব্রাকিশ ওয়াটার বলা হয়। এ কারণে এই পানির প্রভাবাধীন এলাকাকে ব্রাকিশ ওয়াটার জোন বলে। এই প্রতিবেশব্যবস্থার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য এটি দ্রুত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে জীববৈচিত্র্যের আধার। ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের কারণে উদ্ভিদের পাতা পানির সঙ্গে মিশে জলজ প্রাণী, বিশেষত মাছের খাবার জোগান দেয়। এখানকার মাছ এ কারণে অনন্য স্বাদের। সা¤প্রতিককালে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমেছে; বিশেষত উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে জোয়ারের পানি অর্থাৎ সাগরের নোনা পানির চাপ বেড়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আমাদের মিষ্টি পানির উৎস হচ্ছে পাহাড়বাহিত নদী ও বৃষ্টির পানি। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া এবং উজানের নদীগুলো থেকে একেবারেই পানি না আসায় জোয়ারের চাপে সাগরের পানি বেশি চলে আসায় নোনার আধিক্য ধরা পড়ে, যা বৃষ্টি হলেই কমে যায়। উজানের নদীগুলোর পানি নানাভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমাদের এখানে মিষ্টি পানির সংকট দেখা দেয়। বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখন নোনা পানির দাপট বেশি থাকে। উপরন্তু পশ্চিম অংশে বিদ্যাধরী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিষ্টি পানির জোগান প্রায় বন্ধ। ফলে নোনার তেজ বেড়েছে। মাটি ও পানিতে নোনার বাড়বাড়ন্তে অনেক প্রজাতির গাছ একেবারেই হচ্ছে না অথবা সাংঘাতিকভাবে এর বৃদ্ধি কমে গেছে। যেমনÍসুন্দরী, গোলপাতা। শুষ্ক মৌসুমে নোনার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বৃদ্ধি পায়।’
ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদরাজি বায়ুম-ল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নেয়। এতে পরিবেশের দূষণ কমে। কার্বন ডাই-অক্সাইডকে খাদ্যে রূপান্তর করে নোনা পানির এই উদ্ভিদরাজি বেড়ে ওঠে। অথচ বাড়তি নোনাই তাদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে ৩৪ প্রজাতির গাছ আছে। এর মধ্যে কেওড়াগাছ সর্বাধিক কার্বন ডাই-অক্সাইড তার শিকড়, কা-, ডালপালা ও পাতায় আটকে রাখতে পারে। এক হেক্টর কেওড়াবন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখতে পারে। বাইনের ক্ষেত্রে তা ১১৫ টন, গেওয়ায় তা ২৩ টন। গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্ষমতা কমতে থাকে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে মোটামুটি ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে আছে! এর সঙ্গে প্রতিবছর আরো ৩৮ লাখ টন যোগ হচ্ছে। আটকে থাকা এই বিষ-গ্যাসের একাংশ শর্করায় পরিণত হওয়ায় প্রতিবছর এরা আরো গ্যাস আটকে রাখতে সক্ষম হয়।
এই বনের মৎস্যসম্পদের (মাছ ও চিংড়ি, কাঁকড়া, কুঁচে প্রভৃতি) ওপর এখনো বিপুল সংখ্যায় মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। বিশেষত ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে সুন্দরবন মানুষের জীবন ও জনপদকে রক্ষা করে চলেছে। সা¤প্রতিককালে আঘাত হানা আম্ফান, ইয়াসেও সুন্দরবন বুক চিতিয়ে রক্ষা করেছে। অবশ্য নদীগর্ভে অধিক হারে পলি জমছে। এতে নদীগুলোর গভীরতা কমে যাচ্ছে। এ কারণে ইয়াসে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের প্রায় পুরো এলাকা তিন থেকে চার দিন ডুবে ছিল। বনের মধ্যকার মিষ্টি পানির পুকুরগুলো নোনাক্রান্ত হয়। এতে প্রাণিকুল সুপেয় পানির সংকটে পড়ে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘প্রাকৃতিক কারণেই সুন্দরবনের নানা পরিবর্তন ঘটছে। দৃশ্যমানভাবে আমরা অনেক গাছ, অনেক প্রাণী, অনেক পাখি হারিয়ে গেছে বলে জানতে পারছি। পুরনো তথ্যে দেখা যায়, সুন্দরবনে গ-ারও ছিল, এখন নেই। অন্যদিকে নোনার মাত্রা বেড়েছে, মিষ্টি পানির প্রবাহ কমেছে। এই অতিরিক্ত নোনাই সুন্দরবনের জন্য সমস্যা। তবে শত বছরেরও বেশি আগের ১৯০৩ সালের ডকুমেন্ট বলছে, এই অঞ্চলে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমছে।’ অতিরিক্ত নোনার চাপে উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আসবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নোনায় যেসব গাছ স্বাচ্ছন্দ্য, তারা টিকে থাকবে, কম নোনা সহনশীল গাছগুলো কমে যাবে বা মরে যাবে।’ বিশ্বের সবচেয়ে একক বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হচ্ছে সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে এর আয়তন ১০ হাজার ২৩০ বর্গকিলোমিটার। এর ছয় হাজার ৩০ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে। বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।