করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মেয়াদ আগামী মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে দেশের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিল্প, কলকারখানা বিধিনিষেধের আওতা-বহির্ভূত থাকবে।
এর আগে মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করণীয় নির্ধারণে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের এক সভায় লকডাউন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সচিবালয়ে সভা শেষে তিনি জানান, আগামী ১১ আগস্ট থেকে দোকানপাট ও অফিস-আদালত খুলে দেওয়া হবে, সীমিত পরিসরে চলবে গণপরিবহনও। তবে এর আগেই সব কর্মজীবী মানুষকে করোনার টিকা গ্রহণ করতে হবে।
টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, ৭ আগস্ট থেকে সারা দেশে ১৪ হাজার কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হবে। ৭ থেকে ১০ আগস্ট, তিন দিনের মধ্যে ১ কোটি কর্মজীবী মানুষ টিকা পাবেন। কোনও শ্রমজীবী মানুষ টিকা গ্রহণ না করে কর্মস্থলে যেতে পারবেন না, দোকানদার দোকান খুলতে পারবেন না, চালক গাড়ি চালাতে পারবেন না। টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে পঞ্চাশোর্ধ্ব দোকানদার, গণপরিবহনের চালক, সহকারী ও সুপারভাইজাররা অগ্রাধিকার পাবেন বলেও জানান মন্ত্রী। ভ্যাকসিন না নিয়ে কেউ আর কর্মস্থলে আসতে পারবে না উল্লেখ করে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, এখন ওয়েবসাইটে ভ্যাকসিনের তথ্য আছে, কেউ মিথ্যা তথ্য দিতে পারবে না।
প্রসঙ্গত, গেলো বছর মার্চের ৮ তারিখ করোনার প্রথম সংক্রমণ দেশে ধরা পড়ে। দ্বিতীয় ধাক্কায় চলতি বছরের জুন মাসে অবস্থা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছালে ১ জুলাই থেকে সারাদেশে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। এ সময় গণপরিবহনের সঙ্গে বন্ধ রয়েছে সরকারি বেসরকারি অফিস এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানও। ঈদুল আজহা উপলক্ষে আট দিনের জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করে সরকার। পরে ২৩ জুলাই থেকে আবারও বিধিনিষেধ জারি হয়েছে, যা ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলার কথা ছিল।
করোনা আক্রান্তদের ৯৮ শতাংশের দেহে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট: করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের ৯৮ শতাংশের শরীরেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। গতকাল বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিল্টন হলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে করোনার জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল প্রকাশের সময় তিনি এই তথ্য জানান। ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ জানান, চলতি বছরের ২৯ জুন থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত সারাদেশব্যাপী রোগীদের ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, গবেষণায় দেশের সব বিভাগের রিপ্রেজেন্টেটিভ স্যাম্পলিং করা হয়। গবেষণায় মোট ৩০০ কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর ন্যাযোফ্যারিনজিয়াল সোয়াব স্যাম্পল থেকে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়।
গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পুরুষ। তবে বিএসএমএমইউ’র গবেষণায় ৯ মাস থেকে শুরু করে ৯০ বছরের বয়স পর্যন্ত রোগী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এরমধ্যে ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সের রোগীর সংখ্যা বেশি। যেহেতু কোনো বয়স সীমাকেই কোভিড-১৯ এর জন্য ইমিউন করছে না, সে হিসেবে শিশুদের মধ্যেও যে কোভিড সংক্রমণ ঝুঁকি নেই, তা বলা যাচ্ছে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে যেমন- ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিস তাদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি ষাটোর্ধ বয়সের রোগীদের দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে সেক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। যদিও এ গবেষণায় টিকার কার্যকারিতার বিষয়টি চলমান রয়েছে। করোনার জেনোম সিকোয়েন্সিং বিশ্লেষণ গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে গত ডিসেম্বরে ইউকে বা আলফা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমণ হার বেশি ছিল। পরে মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী সাউথ আফ্রিকান বা বেটা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমণ হার বেশি ছিল।
উপাচার্য জানান, গত এক মাসের ৩০০ স্যাম্পলের জেনোম সিকোয়েন্সিংয়ে দেখা যায় মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। ১ শতাংশ হচ্ছে সাউথ আফ্রিকান বা বেটা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমণ। যদিও গবেষণার প্রথম ১৫ দিনে এই সংখ্যা ছিল ৩ শতাংশ। একজন রোগীর ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছি মরিশাস ভ্যারিয়েন্ট অথবা নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট। শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনা অনেক ক্ষেত্রে বহমান জীবন-যাপনের বাধা তৈরি করলেও জীবন থেমে নেই। অন্যান্য জেনেটিক্স রোগগুলোর ওপর গবেষণা কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু করা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব ডাটা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। গবেষণার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনার জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার উদ্দেশ্য ভাইরাসটির জিনোমের চরিত্র উন্মোচন, মিউটেশনের ধরণ এবং বৈশ্বিক ভাইরাসের জিনোমের সঙ্গে এর সম্পর্ক বের করা এবং বাংলাদেশি কোভিড-১৯ জিনোম ডাটাবেস তৈরি করা।