করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরোপিত কঠোর বিধিনিষেধের কিছু শর্ত শিথিল করেছে সরকার। এরমধ্যে যানবাহন চলাচলসহ মার্কেট, দোকানপাট, শপিং মল স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘদিন এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর আবারও চালু হওয়ায় মানুষ উপচে পড়ছে প্রয়োজনীয় কেনাকটায়। মুখে মাস্ক থাকলেও সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই নেই কারও মধ্যে। একজনের থেকে আরেকজন নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থানের কথা থাকলেও তা প্রায় সব জায়গায় উপেক্ষিত। বুধবার (১১ আগস্ট) রাজধানীর কয়েকটি শপিং মল ও নিউমার্কেট ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। নিউমার্কেট এলাকায় দেখা যায় ক্রেতাদের চিরচেনা ভিড়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদায় ক্রেতারা ভিড় করছেন ফুটপাথের ওপর অবস্থানকারী হকারদের কাছে। আবার অনেকেই মার্কেটের ভেতরে ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তবে মার্কেটের জায়গা কম থাকায় তৈরি হচ্ছে জটলা। একজন আরেকজনের সঙ্গে গা-ঘেঁষেই করছেন কেনাকাটা। আবার কেউবা গা-ঘেঁষেই যাওয়া আসা করছেন। আবার অনেকে কথা বলার সুবিধার্থে মাস্ক নামিয়ে দরদাম করছেন। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার নূরজাহান কমপ্লেক্সের সামনে ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করেন ফজলু। তিনি জানান, অনেক দিন পর মার্কেট খোলায় ক্রেতারা আসতে শুরু করেছেন। অনেক দিন আয় না থাকায় বিপদে পড়েছেন তার মতো সব বিক্রেতা। তাই স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের কথা অনেকটা ভুলতে বসেছেন তারা।ফজলু বলেন, ‘বেচাকেনা নেই অনেক দিন। এখন কাস্টমার আইসা যদি দাঁড়ান, কাপড় দেখেন, আমরা কী বলতে পারি? দূরে দাঁড়াইতে তো বলতে পারি না। আর দূরে দাঁড়াইলেও কই দাঁড়াইবো? পরে তো চইলা যাবো আরেক দোকানে। এটা আমার লস না?’
এই দোকানেই পোশাক কিনতে আসা রেহনুমা বেগমের কাছে স্বাস্থ্যবিধির বিষয় জানতে চাইলে তিনি জানান, তার টিকা নেওয়া আছে দুই ডোজ। আর কোনও উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে চলে যান তিনি।
বিক্রেতারা বলছেন, মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি পালন করানো খুব দুরূহ কাজ। নিউমার্কেটের মতো জায়গায় সেটা আরও কষ্টসাধ্য। কারণ, দোকানগুলো ছোট ছোট আর জায়গা কম। রাজধানীর কয়েকটি শপিং মল ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতারা মাস্ক পরেই প্রবেশ করছেন। কিন্তু পরক্ষণেই থুতনিতে নামিয়ে ফেলছেন মাস্ক। দোকানেও দেখা যায় একই পরিস্থিতি। দোকানির মাস্ক মুখে থাকলেও ক্রেতার মাস্ক থুতনিতে। আবার একাধিক ক্রেতা পাশাপাশি দাঁড়িয়েই করছেন কেনাকাটা। তোয়াক্কা নেই স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্বের।
করোনা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে: করোনা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি না হওয়া সত্ত্বেও তুলে দেয়া হলো লকডাউন। গত বুধবারও দেশে ১০ হাজার ৪২০ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাহলে কি করোনামুক্ত হতে চলেছে দেশ, এই প্রশ্নে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দেশ করোনামুক্ত হতে যাচ্ছে না বরং কয়েক দিন পর করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার এ সময়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ঝড়ের গতিতে বাড়তে পারে। করোনা সংক্রমণ এমনভাবে বেড়ে যেতে পারে যে তা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য সম্ভব নাও হতে পারে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের সাবেক ডিন, শিশু সার্জারি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, সংক্রমণ না কমিয়ে লকডাউন তুলে নেয়াটা সরকারের সঙ্গত সিদ্ধান্ত হয়নি। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের এ সময়ে মানুষের অবাধ চলাচল থাকলে একটা সময় সংক্রমণ বেড়ে এমন অবস্থা হতে পারে যে, কোনো হাসপাতালেই ভর্তি করার মতো কোনো বেড পাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, যে লকডাউনটা হলো তা যেমন ছিল ঢিলাঢালা, এটা খুব বেশি কাজে লাগেনি, আবার লকডাউন তুলে দিয়ে অবাধ চলাফেরা করার অনুমতি দেয়ায় করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে সুনামির গতিতে।’
বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্যবিদ ডা: আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সংক্রমণ না কমিয়ে লকডাউন তুলে দেয়াটা উচিত হয়নি। মানুষতো স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায় না। মানুষ মাস্ক পরা ছাড়াই বাইরে চলাচল করবে। ফলে এমন হতে পারে যে সামনের দিনগুলোতে করোনা আক্রান্ত হয়ে মানুষ হাসপাতালে আসবে চিকিৎসা নিতে কিন্তু যথেষ্ট সিট না থাকায় ভর্তি হতে পারবে না, ফলে মৃত্যুও বেড়ে যেতে পারে। ডা:
আবু জামিল ফয়সাল আরো বলেন, মাস্ক পরার আন্দোলনটিকে সরকারও সেভাবে বাস্তবায়ন করল না। মাস্কের প্রতি জোর না দিয়ে সরকার আরো কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। এসব বিধিনিষেধ জনগণের কোনো উপকারে আসেনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক বলেন, লকডাউন তুলে দেয়ায় স্বাভাবিক নিয়মে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। কারণ স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলায় সাধারণ মানুষের খুব বেশি আগ্রহ নেই। মাস্ক, স্যানিটাইজ এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে চলাফেরা করা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
তিনি বলেন, সরকার অর্ধেক বাস চলাচলের অনুমতি দিয়েছে কিন্তু এবার সরকার বলেনি যে, অর্ধেক সিট ফাঁকা রেখে এবং দূরত্ব বজায় রেখে বাসে যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। বাসের মধ্যে অবশ্যই মাস্ক ও দূরত্ব বজায় রেখে যাতায়াত করতে হবে। পরে বাস থেকে নেমে গেলে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এর কোনো কিছুই মানুষ মানে না। বাস ড্রাইভার অথবা কন্ডাক্টররা এসব মানে না। অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, করোনায় অনেক সময় উপসর্গ দেখা দেয় না। উপসর্গ না থাকলে একজন মনে করতেই পারেন যে তিনি সুস্থ। কিন্তু তার সংস্পর্শে আসা পাশের ব্যক্তিটির মুখে মাস্ক না থাকলে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে যেতে পারেন। সে কারণে সবার মুখে মাস্ক থাকলে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (নিকডু) হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক ডা: তৌহিদ হোসেন অবশ্য ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, লকডাউন তুলে দিলেও করোনা সংক্রমণ এখন থেকে কমে যাবে। এ সময়ে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা নেই। তবে সামনে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে করোনার আরেকটি ঢেউ আসতে পারে। কিন্তু মানুষ যদি মানসম্মত মাস্ক পরার অভ্যাস করতে পারে তাহলে করোনার ঊর্ধ্বমুখী ঢেউ ভেঙে গিয়ে মোট সংক্রমণ কমে যাবে।