করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছেই না। চিকিৎসার জন্য আক্রান্তদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন স্বজনরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে তোলা। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছেই না। চিকিৎসার জন্য আক্রান্তদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন স্বজনরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে তোলা। বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালানো ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে পাওয়া গেছে বলে গত ৮ মে প্রথম জানা যায়। ভারত ফেরত কয়েকজন ব্যক্তির নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে। এরপর একে একে আরও পাওয়া যায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) মে মাসের মাঝামাঝি থেকে যেসব করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করেছে, তার ৮০ শতাংশেই পাওয়া যায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এরপর থেকে শুরু হয় করোনার উচ্চমুখী সংক্রমণ। এর তিন মাস পর এখন মধ্য আগস্টে সংক্রমণের হার নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে।
মে থেকে শুরু হয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপট: ২৪ মে থেকে জানা যায়, সীমান্তবর্তী সাত এলাকায় বেড়েছে করোনার সংক্রমণ। তার আগেই বেপরোয়া ঈদ যাত্রায় করোনার সংক্রমণ বাড়বে বলে সতর্ক করেছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনুমান সঠিক প্রমাণ করেছে ঈদের পরপরই সংক্রমণের নতুন মাত্রা। দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা আছে ৩০টি। এর মধ্যে গত মে মাসে সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে ৭ জেলায়। এই জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এরপর সেখান থেকে পুরো রাজশাহী বিভাগে করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অবনতি হতে থাকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর করোনা পরিস্থিতির অবনতির হতে থাকে সাতক্ষীরা জেলায়। সেখান থেকে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে পুরো খুলনা বিভাগের। খুলনা বিভাগের প্রায় সব জেলাতেই সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এর মধ্যে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় সংক্রমণ বেড়ে যায়।
এরপর পরিস্থিতি পাল্টায় রংপুর বিভাগে। এই বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে বাড়তে থাকে করোনা রোগী। এরমধ্যে দিনাজপুরে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বাড়ে। দিনাজপুরের সঙ্গে বাড়তে থাকে চট্টগ্রাম জেলায় করোনা রোগী। এরপর ঢাকা বিভাগেও দেখা দেয় করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। এই বিভাগের ফরিদপুরে প্রথমে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এরপর গোপালগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং রাজবাড়িতে বেড়ে যায় শনাক্তের হার। এরপর একে একে সারাদেশে ডেল্টার তা-ব দেখা দেয়।
ঢাকার পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে জুনের মাঝামাঝি থেকে: রাজধানী ঢাকায় করোনা শনাক্তের হার নি¤œমুখী থাকলেও তা বেড়েছে ১৯ জুন থেকে। তার আগের দিন করোনায় শনাক্ত ছিল ৪৭৩ জন। ১৯ জুন শনাক্ত হয় ১ হাজার ১১৪ জন। এরপর শুধু ঢাকা নয় সারাদেশেই করোনা শনাক্ত এবং মৃত্যু বাড়তে থেকে। জুন মাস শেষ হওয়ার আগেই একদিনে শনাক্ত প্রায় ৯ হাজারের কাছাকাছি চলে যায়, যা এর আগে কখনও হয়নি। মে মাসে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত ছিল ১ হাজার ৭১০ জন। জুলাই মাসে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত হয় ১৬ হাজার ২৩০ জন। জুলাই মাসে ঈদের সময় নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় শনাক্ত কম ছিল। কিন্তু পুরো মাসেই গড়ে ১০ হাজার করে করোনার আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। আর তাতে করে চাপে পড়তে থাকে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে।
শনাক্তের সঙ্গে মৃত্যুর মিছিল: দেশে করোনার সংক্রমণ যখন বাড়ছিল তখন একই সঙ্গে শুরু হয়েছিল মৃত্যুর মিছিল। পুরো মে মাসজুড়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যান গড়ে প্রতিদিন ৩৫ জন হলেও জুনে বাড়তে বাড়তে মৃত্যু ১১৫ পর্যন্ত হয় একদিনে। জনে মোট শনাক্ত হয় ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন এবং মৃত্যু হয় ১ হাজার ৮৮৪ জনের। জুলাইতে শনাক্ত বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জনে এবং মৃত্যু হয় ৬ হাজার ১৮২ জনের। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ২৫০ জন মারা গেলেও ১২ আগস্ট থেকে মৃত্যুর হার কমতে শুরু করে। ১২ আগস্ট মৃত্যু হয় ২১৫ জনের, ১৩ আগস্ট ১৯৭ জনের, ১৪ আগস্ট ১৭৮ জনের এবং ১৫ আগস্ট ১৮৭ জনের মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
শনাক্তের ক্ষেত্রেও একইরকম চিত্র দেখা যায়। ১২ আগস্ট থেকে শনাক্ত ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সর্বশেষ শনিবার শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ৬৮৪ জন। আর ১৩ আগস্ট থেকে শনাক্ত নেমে আসে ১০ হাজারের নিচে। জুলাইয়ের পুরো মাসে গড়ে প্রতিদিন ১১ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার জুলাইতে ৩২ শতাংশ হলেও তা বর্তমানে ২০ শতাংশের কাছাকাছি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি কমতে শুরু করেছে। গতমাসেও আমাদের সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল। সংক্রমণের হার ৩২ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। এখন এটা কমে গিয়ে ২০ শতাংশের মধ্যে চলে এসেছে। তবে সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছু কমলেও আমরা সন্তুষ্ট নই, আমরা ৫ শতাংশের নিচে সংক্রমণ চাই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘এভাবে যদি কমতে থাকে, তাহলে অবশ্যই বলা যাবে আমাদের সংক্রমণের হার কমে আসছে। কিন্তু আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, টেস্ট কতটুকু হচ্ছে। গত কয়েকদিনে ৪০-৫০ হাজার পর্যন্ত টেস্ট হয়েছে। সেখান থেকে ৩০ হাজারে নেমে আসছে। যার কারণে সংক্রমণের হারও কমে আসছে। সেজন্য আমাদের সব দিকেই খেয়াল রাখতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ টেস্ট করাতে আসে না। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ কেউ টেস্ট করাতে আসে না। এখন তাদের কাছে যাওয়া বা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই আমরা কিন্তু সঠিক চিত্র বুঝতে পারবো। এখনও ঢাকাতে ২০ শতাংশ হলেও ঢাকার বাইরে অনেক জেলায় সংক্রমণের হার অনেক বেশি। হয়তো এখানে কিছু সাময়িকভাবে কমতে পারে। হয়তো পরীক্ষার হারের কারণে কমেছে। আমাদের এখন হয়তো নিচের দিকে নামছে, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে আমাদের যে অনীহা, তাতে আবারও যেকোনও সময় বেড়ে যাবে।’-বাংলাট্রিবিউন