ছয়টি নদীর পানি ১৩টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশের উত্তর, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের ১০টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। গত সোমবার (৩০ আগস্ট) বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর অবস্থার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে যমুনা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল রয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় উভয় নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে।
গঙ্গা নদীর পানি সমতল কমেছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরদিকে পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে। এই পানি বাড়ার ধারা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অপার মেঘনা অববাহিকার মনু ও খোয়াই ব্যতীত প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী এবং ফরিদপুর জেলার নি¤œাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরও জানায়, যমুনা নদীর আটটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে ফুলছড়ি পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার, কাজিপুর পয়েন্টে ৩১ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৩৪ সেন্টিমিটার, পোড়াবাড়ি পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার, মথুরা পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার ও আরিচা পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি বইছে।
এদিকে, পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে আত্রাই নদীর বাঘাবাড়ি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ধলেশ্বরী নদীর এলাসিন পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্টে পানি ৩৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাইদ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী তিনদিন আরও পানি বাড়তে পারে। তবে ১ তারিখের পর পানি আবারও কমতে শুরু করবে বলে জানান তিনি। ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার নি¤œাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে পড়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকার অন্তত ৩৫ হাজার পরিবার। তলিয়ে গেছে নিচু এলাকার কয়েক হাজার হেক্টর জমির রোপা আমনসহ সবজি ক্ষেত ও আমনের বীজতলা।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির বলেন, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও পরিমাণ খুবই কম। সেক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দিকে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রতি মুহূর্তে যমুনা নদীর বাঁধ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
উজানের ভারী বৃষ্টিতে দেশের ১২ জেলার নি¤œাঞ্চল তলিয়ে গেছে। এখন আটটি নদীর বিভিন্ন পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় এলাকাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
নতুন করে যমুনা ও তিস্তার তীরবর্তী আরও কিছু এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছে বন্যা ও পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও আবহাওয়া অধিদফতর। ১২টি জেলা হচ্ছে- কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরিয়তপুর এবং চাঁদপুর।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা জানান, উজানে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণেও নদীগুলোর পানি বাড়ছে। আগামী সাত দিন পরিস্থিতি এমন থাকার আশঙ্কা করছি আমরা। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি বাড়ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এতে যমুনার পুরাবাড়ি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমা ছাড়াতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা ও কুশিয়ারার পানিও বাড়তে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, গঙ্গার পানি কমছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার কুশিয়ারা বাদে অন্য নদ-নদীগুলোর পানিও কমছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরও জানায়, পদ্মার গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৫৩ থেকে কমে ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরেশ্বর পয়েন্টের পানি ২৮ থেকে কমে ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যকূল পয়েন্টের পানিও বিপৎসীমার নিচে। যমুনা নদীর মথুরা পয়েন্টের পানি ৩ থেকে কমে ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। একই নদীর আরিচা পয়েন্টের পানি ৫ থেকে কমে ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। দুই পয়েন্টে পানি কিছুটা কমলেও নতুন করে এই নদীর বাহাদুরাবাদ পয়েন্টের পানি ২ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ২২, কাজিপুর পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। আত্রাই নদীর বাঘাবাড়ি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ২০ থেকে বেড়ে ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গড়াই নদীর কামারখালি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার নিচে। ধলেশ্বরীর এলাসিন পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ১৬ থেকে বেড়ে ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মেঘনার চাঁদপুর পয়েন্টে ১৯ থেকে কমে ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া দুধকুমার নদীর পাটেশ্বরী পয়েন্টের পানি নতুন করে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার, ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের স্টেশনগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে ডালিয়া স্টেশনে- ৫৭ মিলিমিটার। যা গত বৃহস্পতিবারের তুলনায় কম। বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ বৃষ্টি ছিল শেওলা স্টেশনে- ১২২ মিলিমিটার। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় পঞ্চগড়ে ৪৭, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪০ ও শেওলায় ৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়।
দেশের উজানে ভারতের স্টেশনগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে পাসিঘাটে- ৫৯ মিলিমিটার। গত বৃহস্পতিবার ছিল চেরাপুঞ্জিতে- ১৯৮ মিলিমিটার। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আইজুয়ালে ৫৭, দার্জিলিংয়ে ৪৭ এবং সিলচলে ৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ আছে। পাশাপাশি মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে আকাশে সঞ্চারণশীল মেঘ তৈরি হয়েছে। এ কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাসে বলা হয়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
এখন মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় আছে। এর প্রভাবে রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গাসহ ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু স্থানে অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে দেশের কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘থেমে থেমে অনেক এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি আরও কয়েকদিন স্থায়ী হতে পারে। একইসঙ্গে আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি মাসে স্বল্পমেয়াদী বন্যার কথা আমরা বলেছিলাম। যা এরেইমধ্যে নদী অববাহিকার অঞ্চলগুলোতে দেখা যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহে এই অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে বলে তিনি জানান।’
জামালপুরে পানিবন্দি ৭ শতাধিক পরিবার: জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনটি উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন উপজেলার সাত শতাধিক পরিবার। ইসলামপুর উপজেলার বেলাগাছা, চীনাডুলী, কুলকান্দি, নোয়ারপাড়া এবং সাপধরী ইউনিয়নের ৭০৫টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া এই উপজেলার চীনাডুলী ইউনিয়নের আটটি পরিবার এবং বেলগাছা ইউনিয়নের ছয়টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। অপরদিকে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানি ইউনিয়নে ভাঙনের কবলে পড়েছে ৪১টি পরিবার। ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গোলাম মোর্শেদ বলেন, এই উপজেলায় যমুনা তীরবর্তী পাঁচটি ইউনিয়নের ৭০৫টি পরিবার বন্যার কবলে পড়েছে। আর ১৪টি পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী বলেন, বন্যার্তদের জন্য ১৩ মেট্রিক টন চাল ও সাত লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।