‘আফগানিস্তানে তালিবান সরকার: চ্যালেঞ্জ ও এর আঞ্চলিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক এক জুম মিটিংয়ে বিশ্লেষকরা বলেছেন- আফগানিস্তান ও তালেবান ইস্যুতে বাংলাদেশকে সতর্কতা এবং ধৈর্য্যের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সম্ভব হলে তালেবানের দোহা অফিসের সঙ্গে ব্যাক চ্যানেল ওপেন করে প্রাথমিক আলোচনা করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই সেই আলোচনায় নিরাপত্তাজনিত আমাদের উদ্বেগগুলো তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের বিষয়ে সম্মুখ ধারণা লাভের চেষ্টা করতে হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল অ্যাফেয়ার্স গতকাল বুধবার সকালে ওই ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করে। প্রায় সোয়া ঘণ্টাব্যাপী ওই আলোচনায় বক্তারা বেশ কিছু বিষয়ে প্রায় অভিন্ন মতামত দেন। তারা বলেন, আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক বা যোগাযোগে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ওই দেশ নিয়ে প্রতিবেশি ভারত এবং চীনের পরস্পরবিরোধী অবস্থান রয়েছে। যেহেতু উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে ফলে আমাদের কোন সিদ্ধান্তকে যেনো তারা প্রভাবিত করতে না পারে সে ব্যাপারে সদা সজাগ থাকতে হবে। স্টাডি গ্রুপের চিফ এক্সিকিউটিভ সাংবাদিক আমির খসরুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম), নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও প্রেসিডেন্ট বিপস মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি ফায়জুল্লাহ। সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন, যৌক্তিক জবাব, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা স্টাডি গ্রুপের ওই আলোচনার মূল ফোকাস ছিল পরিবর্তনের অঙ্গীকারকারী তালেবান নেতৃত্ব আদতে কী পারবে সমন্বিত কোন সরকার উপহার দিতে, যার মধ্য দিয়ে বহুজাতিক ওই রাষ্ট্রে শান্তি ফিরবে?
জবাবে বিশ্লেষকরা নানাভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। ড. হোসেন জিল্লুর মনে করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠাই তালেবান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতির প্রশ্নে তিনি ভূ-রাজনীতি, রি-এলাইনমেন্ট এবং জাতীয় স্বার্থ- এই ৩টি বিষয় বিবেচনার পরামর্শ দেন। দুনিয়াতে ধর্ম নিয়ে অনেক উদ্দেশ্যমূলক আলোচনা আছে মন্তব্য করে তিনি ধর্মীয় ইস্যুতে সৎ আলোচনার তাগিদ দেন। একইসঙ্গে মহানবী শিক্ষাগ্রহণ এবং এর প্রসারে যে জোর দিয়েছেন তাও তুলে ধরেন। ড. হোসেন জিল্লুর বলেন, উগ্রবাদ নিয়ে ম্যানুপুলেটেড এবং আইডোলজিক্যাল- দু’ধরনের আলোচনা রয়েছে। সবাই নীতির কথা বলেন, কিন্তু আদতে ক্ষমতার খেলা। আফগানিস্তান ইস্যুতে বাংলাদেশকে আরও পরিপক্কতার সঙ্গে বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
আলোচনায় নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান বলেন, এ এক নতুন আফগানিস্তান। এখানে নতুন করে সুশীল সমাজ গড়ে উঠেছে। বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী। তারা পূর্বের তালেবানদের শাসন দেখেনি। নতুন প্রজন্মের আফগানিস্তানে তাদের চাওয়া-পাওয়া এবং আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিতে। তাদের কণ্ঠ শুনতে হবে। বাংলাদেশকে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সম্ভব হলে ওই তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আলোচনায় ব্যাক চ্যানেলে তালেবানের দোহা অফিসের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ চেষ্টা সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিষয়ে ওই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, যোগাযোগ করা যেতে পারে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির আগে আমাদের উদ্বেগগুলোকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। তিনি চীনের উদাহরণ টেনে বলেন, তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিনজিয়ান প্রদেশের বিদ্রোহী ইটিআইএনকে কোনভাবে মদত না দেয়ার অঙ্গীকার নিয়েছেন। বাংলাদেশকেও নিরাপত্তা উদ্বেগে বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে হবে সবার আগে। তালেবান সরকার নিয়ে ইরান, রাশিয়ার মতো অন্য রাষ্ট্রগুলোর অবজারভেশনও বিবেচনায় রাখার তাগিদ দেন জ্যেষ্ঠ ওই গবেষক কাম বিশ্লেষক।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম বলেছেন, বর্তমান তালেবানের আচরণ নতুন বোতলে পুরনো মদ কিনা সেটাই দেখার বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ তালেবানের মতাদর্শকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনেক ঘাটতি থাকলেও তালেবানের কোন গোষ্ঠীকে এদেশের মানুষ স্থান দেবে না। তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে আফগানিস্তান তালেবানের হাতে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো না এমনটা আমি সমর্থন করি না। হ্যা, আমাদের অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে। জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আফগানিস্তান সার্কের সদস্য। তাদের সঙ্গে আমাদের বহুমুখী যোগাযোগ রয়েছে। আমি ২০১২ সালে আফগানিস্তান সফর করেছি জাতিসংঘের একটি টিমের সদস্য হয়ে। আমি দেখেছি ব্র্যাক সেখানে চমৎকার কাজ করেছে। আফগানিস্তানের মানুষ ব্র্যাকের কার্যক্রমকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। তালেবানের নতুন সরকারের আমলে আমরা সেই কার্যক্রম চালাতে পারবো কিনা সেটা বুঝতে হবে। একইসঙ্গে গণতন্ত্র, স্কুল-কলেজ, নারীর শিক্ষার বিষয়ে তালেবানের মনোভাব আমাদের বুঝতে হবে। এই বোঝাপড়ার জন্য দরকার ব্যাক চ্যানেলে দোহা অফিসে যোগাযোগ। মনে রাখতে হবে অস্থিতিশীল আফগানিস্তান করো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।