‘তারা বলল, হে জুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে; আমরা কি আপনাকে কর দেবো এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মাঝে এক প্রাচীর গড়ে দেবেন?’ (সূরা কাহফ-৯৪)
‘ইয়াজুজ ও মাজুজ দু’টি জাতি, সহিহ হাদিস মোতাবেক এরা মানুষ জাতি। এদের সংখ্যা অন্যান্য জাতির তুলনায় অনেক বেশি হবে এবং তাদের দিয়েই জাহান্নামের বেশি অংশ পূর্ণ করা হবে।’ (বুখারি, সূরা হজ্জের তফসির, মুসলিম ঈমান অধ্যায়) কিয়ামতের আবির্ভাব হবে ইসরাফিল আ:-এর সিঙ্গায় ফুঁৎকারের মাধ্যমে এবং মানুষকে কবর থেকে পুনরায় উত্থান করা হবে আরেকটি ফুঁৎকারের মাধ্যমে। এই সম্পর্কে হাদিস এসেছে- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘উভয় ফুঁৎকারের মাঝে (ব্যবধান) ৪০ হবে। সাহাবিরা বললেন, হে আবু হুরায়রা! ৪০ দিন (ব্যবধান)? তিনি বললেন, আমি এ ব্যাপারে সন্দিহান। তারা আবারো প্রশ্ন করলেন, এ কি ৪০ মাস? এবারো তিনি বললেন, এ সন্দেহ পোষণ করি। তারা আবারো বলল, তা কি ৪০ বছর? তিনি বললেন, আমি তা বলি না। তারপর আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত হবে, এতে মানুষ উদ্গত হবে যেমন উদ্ভিদ উদ্গত হয়।
এরপর তিনি বললেন, ‘একটি হাড় ছাড়া মানুষের সব শরীর পচে যাবে। আর সে হাড়টি হলো মেরুদ-ের হাড়। কিয়ামতের দিন এ হাড় থেকেই পুনরায় মানুষকে পুনঃসৃষ্ট করা হবে।’ (মুসলিম-৭৩০৪)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না রোমীয় (সিরিয়ার অন্তর্গত) সেনাবাহিনী আমাক অথবা দাবিক নহরের কাছে অবতীর্ণ হবে। তখন তাদের মোকাবেলায় মদিনা থেকে এ দুনিয়ার সর্বোত্তম মানুষের একদল সৈন্য বের হবে। তারপর উভয় দল সারিবদ্ধভাবে দ-ায়মান হওয়ার পর রোমীয়রা বলবে, তোমরা ওই সমস্ত লোকদের থেকে পৃথক হয়ে যাও, যারা আমাদের লোকদের বন্দী করেছে। আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করব। তখন মুসলিমরা বলবে, আল্লাহর শপথ! আমরা আমাদের ভাইদের সাথে কখনো সম্পর্কোচ্ছেদ করব না। পরিশেষে তাদের পরস্পর যুদ্ধ হবে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য পলায়নপর হবে। আল্লাহতায়ালা কখনো তাদের তাওবাহ গ্রহণ করবেন না। সৈন্যদের এক-তৃতীয়াংশ নিহত হবে এবং তারা হবে আল্লাহর কাছে শহীদানের মাঝে সর্বোত্তম শহীদ। আর সৈন্যদের অপর তৃতীয়াংশ বিজয়ী হবে। জীবনে আর কখনো তারা ফিৎনায় আক্রান্ত হবে না। তারাই কুস্তুনতিনিয়া বিজয় করবে। তারা নিজেদের তালোয়ার যাইতুন বৃক্ষে লটকিয়ে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ভাগ করতে থাকবে। এমতাবস্থায় তদের মধ্যে শয়তান উচ্চস্বরে বলতে থাকবে, দাজ্জাল তোমাদের পেছনে তোমাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে।
এ কথা শুনে মুসলিমরা সেখান থেকে বের হবে। অথচ এ ছিল মিথ্যা সংবাদ। তারা যখন সিরিয়া পৌঁছবে তখন দাজ্জালের আগমন ঘটবে। যখন মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে এবং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হতে শুরু করা মাত্র সালাতের সময় হবে। অতঃপর ঈসা আ: অবতরণ করবেন এবং সালাতে তাদের ইমামতি করবেন। আল্লাহর শত্রু তাকে দেখামাত্রই বিচলিত হয়ে যাবে, যেমন লবণ পানিতে মিশে যায়। যদি ঈসা আ: তাকে এমনিই ছেড়ে দেন তবে সেও নিজে নিজেই বিগলিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য আল্লাহতায়ালা ঈসা আ:-এর হাতে তাকে হত্যা করাবেন এবং তার রক্ত ঈসা আ:-এর বর্শাতে তিনি তাদের দেখিয়ে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম-৭১৭০)
‘আমার উম্মতের মধ্যেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে এবং সে ৪০ পর্যন্ত অবস্থান করবে। আমি জানি না ৪০ দিন, না ৪০ মাস, না ৪০ বছর। এ সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মারইয়াম তনয় ঈসা আ:কে প্রেরণ করবেন। তাঁর আকৃতি উরওয়াহ ইবনে মাসউদের অবিকল হবে। তিনি দাজ্জালকে সন্ধান করে তাকে ধ্বংস করে দেবেন। তারপর সাতটি বছর লোকেরা এমনভাবে অতিবাহিত করবে যে, দু’ব্যক্তির মধ্যে কোনো শত্রুতা থাকবে না। তখন আল্লাহতায়ালা সিরিয়ার দিক থেকে শীতল বাতাস প্রবাহিত করবেন। ফলে যার হৃদয়ে কল্যাণ বা ঈমান থাকবে, এ ধরনের কোনো লোকই এ দুনিয়াতে আর বেঁচে থাকবে না। বরং এ ধরনের প্রত্যেকের জান আল্লাহতায়ালা কবজ করে নেবেন। এমনকি তোমাদের কোনো লোক যদি পর্বতের গভীরে গিয়ে আত্মগোপন করে তবে সেখানেও বাতাস তার কাছে পৌঁছে তার জান কবজ করে নেবে। তখন খারাপ লোকগুলো পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকবে। দ্রুতগামী পাখি এবং জ্ঞানশূন্য হিংস্র প্রাণীর মতো তাদের স্বভাব হবে। তারা কল্যাণকে অকল্যাণ বলে জানবে এবং অকল্যাণকে অকল্যাণ বলে মনে করবে না। এ সময় শয়তান এক আকৃতিতে তাদের কাছে এসে বলবে, তোমরা কি আহ্বানে সাড়া দেবে না? তারা বলবে, আপনি আমাদেরকে কোন বিষয়ের আদেশ করেছেন? তখন সে তাদেরকে মূর্তি পূজার নির্দেশ দেবে। এমতাবস্থায়ও তাদের জীবনোপকরণে প্রশস্ততা থাকবে এবং তারা স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করবে। তখনই শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে। যে এ আওয়াজ শুনবে সে তার ঘাড় এক দিকে অবনমিত করবে এবং অন্য দিকে উত্তোলন করবে। এ আওয়াজ সর্বপ্রথম ওই লোকই শুনতে পাবে, যে তার উটের জন্য হাওস করার কাজে নিযুক্ত থাকবে। আওয়াজ শুনামাত্রই সে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়বে। সাথে সাথে অন্যান্য লোকেরাও অজ্ঞান হয়ে যাবে। অতঃপর মহান আল্লাহ শুক্র ফোঁটার অথবা ছায়ার মতো বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। এতে মানুষের শরীর পরিবর্ধিত হবে। আবার শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে। অকস্মাৎ তারা দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে।
অতঃপর আহ্বান করা হবে যে, হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে আসো। অতঃপর বলা হবে তাদেরকে থামাও, কারণ তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। তারপর আবারো বলা হবে, জাহান্নামি দল বের করো। জিজ্ঞেস করা হবে, কত জন? উত্তরে বলা হবে, প্রত্যেক হাজার থেকে ৯৯৯ জন। অতঃপর তিনি বললেন, এ-ই তো ওইদিন, যেদিন কিশোর পরিণত হবে বৃদ্ধে এবং এ-ই চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থার দিন। (মুসলিম-৭২৭১)
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘দাজ্জালের সাথে কী থাকবে, এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত অবগত আছি। তার সাথে প্রবাহমান দু’টি নহর থাকবে। একটি দৃশ্যত ধবধবে সাদা পানি বিশিষ্ট এবং অপরটি দৃশ্যত লেলিহান অগ্নির মতো হবে। যদি কেউ সুযোগ পায় তবে সে যেন ওই নহরে প্রবেশ করে যাকে দৃশ্যত অগ্নি মনে হবে এবং চক্ষু বন্ধ করে মাথা অবনমিত করে সে যেন সেটা থেকে পানি পান করে। সেটা হবে ঠা-া পানি। দাজ্জালের চক্ষু লেপা হবে এবং তার চোখের ওপর নখের মতো পুরু চামড়া থাকবে এবং উভয় চোখের মাঝখানে পৃথক পৃথকভাবে কাফির লেখা থাকবে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব মুমিন ব্যক্তি এ লেখা পাঠ করতে পারবে।’ (মুসলিম-৭২৫৭)
দাজ্জালের ফিতনা থেকে মুক্তির জন্য জুমার দিনে সূরা কাহফ পাঠের ফজিলতপূর্ণ একটি হাদিসে এসেছে- ‘তোমাদের মধ্যে যে তাকে পাবে সে যেন তার ওপর সূরা কাহফের প্রথম আয়াতগুলো পড়ে, নিশ্চয় সে বের হবে শাম ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থান থেকে, সে ডানে ও বামে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে, হে আল্লাহর বান্দারা তোমরা দৃঢ় থাকো।’ (হাদিসে কুদসি-১৬২)
‘হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে তোমার আশ্রয় চাই। আমি কবরের আজাব থেকে তোমার আশ্রয় চাই। আমি মাসিহ দাজ্জালের বিপর্যয় থেকে তোমার আশ্রয় চাই। আমি জীবন ও মৃত্যুর বিপর্যয় থেকে তোমার আশ্রয় চাই। আমি কবরের ভয়াবহ সঙ্কট থেকে তোমার আশ্রয় চাই।’ (আদাবুল মুফরাদ-৬৯৯)