গণতন্ত্রের পক্ষের সব দলকে সাথে নিয়ে
গণতন্ত্রের পক্ষের সব দলকে সাথে নিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে বিএনপি’র সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা। সম্প্রতি বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা ছাড়াও বিএনপি সমর্থক বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে দলটি। তারা ১০ থেকে ১২টি বিষয়কে গুরুত্ব দিলেও দুটি বিষয়ে জোর দিচ্ছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়াও গুণগত পরিবর্তন এনে দলকে জনগণের আস্থার জায়গায় নিয়ে যাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা গত ১৫ বছর ধরে করা যায়নি। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, মতবিনিময়সভাগুলো থেকে পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে করণীয় বিষয়ে খসড়া তৈরি করতে দলটির স্থায়ী কমিটির তিন সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সামনের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আগামী দিনে আমাদের দলের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য কী হবে সে বিষয়ে বৈঠকগুলোতে অংশ নেওয়া নেতারা মতামত দিয়েছেন। সম্ভবত আগামী ১৩ অক্টোবর দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের দিন ধার্য আছে। সেখানে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মতবিনিময় করে পাওয়া পরামর্শগুলোর ব্যাপারে দলের যে সিদ্ধান্তই আসুক না কেন, আমরা তা জাতির কাছে, আমাদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তুলে ধরব।’
জানা গেছে, আন্দোলনের প্লাটফর্মে বিরোধী সব দলকে একীভূত করার চেষ্টা করবে বিএনপি। নেতারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না। সে ক্ষেত্রে আন্দোলনও হবে একমুখী, এক দফা এবং সর্বদলীয়। সেটি হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার।
চার দফায় ১০ দিনের মতবিনিময়সভা থেকে যেসব পরামর্শ এসেছে, এর মধ্যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়াসহ দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। আগামী দিনে দলের কর্মকৌশল সেভাবেই ঠিক করা হবে বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন।
বিএনপির ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেন দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা। গত ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর ও ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর দলটির ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদকম-লী, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাংগঠনিক জেলা, দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে দুই দফায় ছয় দিন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তাঁরা। এরপর আইনজীবীসহ দলের সমর্থক বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর এক দফা বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত শুক্র ও শনিবার দুই দিনে আরো ৪৬টি পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। সব বৈঠকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এসব বৈঠক থেকে পাওয়া মতামত লিপিবদ্ধ করেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। সেগুলো পর্যালোচনা করে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের স্থায়ী কমিটির নেতারা ১০ থেকে ১২টি বিষকে গুরুত্ব দিয়ে খসড়া চূড়ান্ত করেছেন।
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকা এক নেতা নাম প্রকাশ না করেবলেন, বেশ কিছু পরামর্শ এসেছে। এর মধ্যে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে নিরপে ক্ষ সরকারের অধীনে করা যায়, সে কর্মপন্থা ঠিক করার পরামর্শই বেশি এসেছে। কর্মপন্থা চূড়ান্ত করার পর পরিস্থিতি বুঝে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি দেবে বিএনপি। রাজপথে নামার আগে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে জনগণের দাবিতে পরিণত করতে চান দলের নীতিনির্ধারকরা। তিনি জানান, নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের পরামর্শ ছাড়া বৈঠকে বেশির ভাগ নেতাই নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আন্দোলন জোরদার করার পক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ দলের অঙ্গসংগঠনগুলো, বিশেষ করে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের দায়িত্ব যোগ্য নেতৃত্বের হাতে দিয়ে পুনর্গঠন করতে বলেছেন, যাতে এসব সংগঠনকে আন্দোলনমুখী করা যায়। এ বিষয়গুলোই চূড়ান্ত খসড়ায় থাকবে। সেটা কাটছাঁট করে স্থায়ী কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্যটাই থাকবে হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না, বিএনপি তাতে যাবে না, সেই নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকারের দাবি কিভাবে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে আন্দোলনে তাদের শামিল করা যায়, সেটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।’
এক দফার ভিত্তিতে সর্বদলীয় আন্দোলনের চিন্তা : নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের এক দফা দাবিতে মাঠের আন্দোলনে নামার চিন্তা করছে বিএনপির হাইকমান্ড। এই আন্দোলন ঠিক কবে নাগাদ শুরু হবে, তা এখনো পর্যন্ত নির্ধারিত না হলেও জানা গেছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী দলগুলোর মত উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে ধারাবাহিক আন্দোলনের সূচনা হবে। যা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের এক দফা দাবিতে রূপ নিতে পারে। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। সর্বদলীয় আন্দোলন গড়ে তুলে এ দাবি আদায় করা হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ দেশের মানুষ আন্দোলন করবেই। আন্দোলন হবেই। কারণ দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন হবে, এ দেশের জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আগে আন্দোলন করেছে, এবারো করবে। তিনি আরো বলেন, দাবি আমাদের একটাই, আমরা শুধু নির্বাচনকালীন সময়ে একটা নিরপেক্ষ সরকার চাই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় বলেন, ‘দেশের জনগণকে মুক্ত করতে চাই স্বল্প সময়ের জন্য একটা মরণকামড় দিতে হবে। ডু অর ডাই- এক দফা।’ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে সাংগঠনিক নানা পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বিএনপি। দল গোছানোর পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয়, তৃণমূল, নাগরিক ও পেশাজীবী সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে সিরিজ বৈঠক করা হয়েছে। এসব বৈঠক থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ মত যুক্ত করে আন্দোলনের পথ পরিক্রমা তৈরি করা হবে।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারসহ বেশ কিছু দফা জাতির সামনে তুলে ধরা হতে পারে। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এসব তুলে ধরা হবে। এতে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে। তবে জাতির সামনে এ রূপরেখা তুলে ধরার দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, দফার সংখ্যা কত হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রাথমিকভাবে তৈরি খসড়ায় অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না- এমনটা ধরে নিয়েই তারা পরিকল্পনা তৈরি করছেন। কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে তা নিয়ে সমমনা রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করবে বিএনপি। প্রয়োজনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাথেও এ ইস্যুতে কথা বলার চিন্তা রয়েছে। দলটির নেতারা জানান, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে তারা একটি স্থায়ী সমাধান চান। যাতে প্রতিবার ভোটের আগে এ ইস্যু নিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। এ দাবির পেছনে যৌক্তিক কারণও তুলে ধরা হবে। দলীয় সরকারের অধীনে বিগত দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরবেন তারা।
নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনের ইচ্ছা থাকলেও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম নিয়েছে। তাই দিন দিন মানুষ ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভোটকেন্দ্রে কমছে ভোটার উপস্থিতি। মানুষকে ভোটকেন্দ্রমুখী করার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। ভোটের আগে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে ভোটারদের মনে আস্থা ফিরে আসে যে, তারা নিজের পছন্দমতো জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে পারবেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক তা সাদরে গ্রহণ করা হবে বলেও জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দেবে দলটি।
দ্বিতীয় দফায় গুরুত্ব পাবে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন। জনগণের আস্থাভাজন একটি কমিশন গঠনে সব দলের সাথে আলোচনা করার প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। তবে তাদের আশঙ্কা যেভাবেই কমিশন গঠন করা হোক তা ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহই হবে। তবে দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠনকে তারা মূল ইস্যু করতে চান না। তাদের মতে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেখানে ইসি যতই শক্তিশালী হোক তাদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন। তবুও এ ইস্যুকে সামনে রেখে কাজ শুরু করেছে দলটি। কমিশন গঠনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে যে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছিলেন তাদের মতামতও নেয়া হবে। ইতোমধ্যে তাদের সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ শুরু হয়েছে। তাদের মতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি দেয়াসহ প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, নির্বাচনকালীন সরকার ও ইসি ছাড়াও আরো কিছু দফা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। এর মধ্যে রয়েছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি। তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হবে। পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীসহ বিরোধী মতের বিরুদ্ধে করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিও জানাবে দলটি।