মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২০ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চল অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত লালমোহনে ডা. আজাহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সভাপতিকে সংবর্ধনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের স্মরণে স্মরণসভা সিংড়ায় পরিবেশ রক্ষার্থে ৫৩৬টি ডাস্টবিন বিতরণ কাজী আজিম উদ্দিন কলেজে শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রদলের ৩১ দফা নিয়ে মতবিনিময় সভা পটুয়াখালীতে শিক্ষক দম্পতি হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন টুঙ্গিপাড়ায় ভিক্ষুক ও হতদরিদ্রদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলো সমাজসেবা অফিস জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের আওতায় এনে সহায়ক কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত ও বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় গঠনের নিমিত্তে দাবি পেশ দাউদকান্দিতে সড়কের মাটি ধসে পড়ল খালে, দুর্ঘটনার আশংকা সীতাকুন্ডে বিতর্কিত মাদ্রাসা পরিচালকের করা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে মানববন্ধন

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষায় ইসলাম

মো: আবদুল গনী শিব্বীর:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২১

আধুনিক বিশ্বে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার বিষয়টি বর্তমানে বেশ আলোচিত। রাষ্ট্রীয় নানাবিধ প্রয়োজনে কিংবা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে বর্তমানে ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় আর গোপনীয় থাকছে না। সরকার নিজ দেশের সাধারণ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের ওপর নজরদারি, বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর আঁড়িপাতার ঘটনা অহরহ ঘটছে। আঁড়িপাতা কিংবা নজরদারির ঘটনায় সচেতন মহলের প্রশ্ন, ব্যক্তিগত সুরক্ষা তাহলে কি নেই?। নানাবিধ সুবিধার কারণে মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং প্রযুক্তির নানা সরঞ্জাম ব্যবহার বাড়ছে। এ সব সরাঞ্জাম ব্যবহারকালীন সময়ে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার নিশ্চয়তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিলেও বর্তমানে ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা’ আর গোপন থাকছে না। জনসম্মুখে গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আলোচিত কিংবা সমলোচিত হচ্ছে এমনকি ক্ষেত্রে বিশেষে হয়রানিরও শিকার হচ্ছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও নানাবিধ কারণে তা শতভাগ কার্যকরী নয়। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার তথ্য ফাঁস মানে ব্যক্তির তথ্য আধিকার খর্ব করা। যা আইন ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে জঘন্য অমার্জনীয় অপরাধ।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। সংবিধানের ওই ধারায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তালাভের অধিকার থাকিবে; এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- একজন ব্যক্তি কখনোই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। এরকম হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইন সুরক্ষিত করতে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের (International Covenant on Civil and Political Rights) ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ, জাতিসঙ্ঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার’-এর ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং জাতিসঙ্ঘের শিশু সুরক্ষা সনদের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে ‘অধিকার’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
ইসলাম ব্যক্তির গোপনীয়তা সুরক্ষার ব্যাপারে তার অনুসারীদেরকে জোর তাগিদ দিয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষায় ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত। পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লøাহপাক ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয়ই কতক ধারণা গোনাহ এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সূরা হুজরাত, আয়াত-১২) পবিত্র কুরআনের সূরা হুজরাতের উল্লিখিত আয়াতে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে- ১. প্রবল ধারণা (অসৎ উদ্দেশ্যে, মন্দ ভাবনায়); ২. কারো কোনো গোপন দোষ সন্ধান করা এবং ৩, গিবত করা। ইসলামে এ তিনটি বিষয় স্পষ্টত হারাম।
আয়াতের প্রথম অংশ প্রবল ধারণা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের কারো আল্লাহর প্রতি সু-ধারণা পোষণ ব্যতীত মৃত্যুবরণ করা উচিত নয়।’ (সহিহ মুসলিম-৫১২৫, আবু দাউদ-২৭০৬, ইবনে মাজাহ-৪১৫৭) অন্য এক হাদিসে আছে ‘আমি আমার বান্দার সাথে তেমনি ব্যবহার করি, যেমন সে আমার সম্বন্ধে ধারণা রাখে। এখন সে আমার প্রতি যা ইচ্ছা ধারণা রাখুক।’ (মুসনাদে আহমাদ-১৫৪৪২) এ থেকে জানা যায়, আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করা ফরজ এবং কু-ধারণা পোষণ করা হারাম। এমনিভাবে যেসব মুসলিম বাহ্যিক অবস্থার দিক দিয়ে সৎকর্মপরায়ণ দৃষ্টিগোচর হয়, তাদের সম্পর্কে প্রমাণ ব্যতিরেকে কু-ধারণা পোষণ করা হারাম। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, ধারণা মিথ্যা কথার নামান্তর।’ (সহিহ বুখারি-৪০৬৬, মুসলিম-২৫৬৩)
আয়াতে আলোচিত দ্বিতীয় নিষিদ্ধ বিষয় হচ্ছে, কারো দোষ সন্ধান করা, যাকে আমরা ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা’ বুঝি। ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে প্রকাশ করার দ্বারা নানা রকম ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়। এ কারণে একবার নবী সা: তার খুতবার দোষ অন্বেষণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘হে সেই সব লোকজন, যারা মুখে ঈমান এনেছ কিন্তু এখনো ঈমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলিমদের ‘গোপনীয়’ বিষয় খোঁজে বেড়িও না। যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ-ত্রুটি তালাশ করে বেড়াবে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটির অন্বেষণে লেগে যাবেন। আর আল্লাহ যার ত্রুটি তালাশ করেন তাকে তার ঘরের মধ্যে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৮০) মুআবিয়া রা: বলেন, আমি নিজে রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি- ‘তুমি যদি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য পেছনে লাগো। তাদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে কিংবা অন্তত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৮৮) অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লøাহ সা: বলেন, ‘মুসলিমদের গিবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লøাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহ যার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্বগৃহেও লাঞ্ছিত করে দেন।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৮০)
ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান না করার এ নির্দেশ শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, বরং ইসলামী সরকারের জন্যও। এ ক্ষেত্রে উমর রা:-এর এ ঘটনা অতীব শিক্ষাপ্রদ। একবার রাতের বেলায় তিনি এক ব্যক্তির কণ্ঠ শুনতে পেলেন। সে গান গাইছিল। তাঁর সন্দেহ হলো। তিনি তার সাথী আবদুুর রহমান ইবনে আওফ রা:কে বললেন, ‘এ ঘরটি কার?’ বলা হলো, এটি রবিআ ইবনে উমাইয়া ইবনে খালফের ঘর। তারা এখন শরাব খাচ্ছে। আপনার কী অভিমত? অতঃপর আবদুর রহমান ইবনে আওফ বললেন, আমার অভিমত হচ্ছে যে, আমরা আল্লাহ যা নিষেধ করেছে তা-ই করে ফেলছি। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তা করতে নিষেধ করে বলেছেন, ‘তোমরা গোপন বিষয়ে অন্বেষণ করো না’। (সূরা হুজুরাত, আয়াত-১২) তখন উমর ফিরে এলেন এবং তাকে ছেড়ে গেলেন। (মুস্তাদরাকে হাকিম-৮২৪৯, মাকারিমুল আখলাক : আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাফর আল খারায়েতি-৩৯৮, ৪২০, মুসান্নাফে আব্দির রাজ্জাক-১০/২২১) এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, খুঁজে খুঁজে মানুষের গোপন দোষ-ত্রুটি বের করা এবং তারপর তাদেরকে পাকড়াও করা শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, ইসলামী সরকারের জন্যও জায়েজ নয়। একটি হাদিসেও এ কথা উল্লিøখিত হয়েছে। ওই হাদিসে নবী সা: বলেছেন, ‘শাসকরা যখন সন্দেহের বশে মানুষের দোষ অনুসন্ধান করতে শুরু করে তখন তা তাদের চরিত্র নষ্ট করে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৮৯)
উল্লেøখ্য যে, বর্তমান আধুনিক বিশ্বে জননিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিশেষ প্রয়োজনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যক্তি বিশেষকে নজরদারির আওতায় আনা কিংবা কোনো তথ্য সংগ্রহ করা আইন ও ধর্মবিরোধী নয়।
আয়াতে নিষিদ্ধ তৃতীয় বিষয় হচ্ছে গিবত। গিবতের সংজ্ঞায় রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কারো এমন কথা বলা যা শুনলে সে অপছন্দ করবে। প্রশ্ন হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সত্যিই থেকে থাকে তাহলে আপনার মত কি? তিনি বললেন, ‘তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেই তো তুমি তার গীবত করলে। আর তা যদি না থাকে তাহলে অপবাদ আরোপ করলে।’ (সহিহ মুসলিম-২৫৮৯, আবু দাউদ-৪৮৭৪, তিরমিজি-১৯৩৪) ইসলাম ধর্মে গিবতের নিষিদ্ধতাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং একে মৃত মুসলিম ভাইয়ের মাংস ভক্ষণের সমতুল্য বলে প্রকাশ করে এর নিষিদ্ধতা ও নিচতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মিরাজের রাত্রির হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, …তারপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো, আমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে গেলাম যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখম-ল ও দেহের মাংস আঁচড়াচ্ছিল। আমি ফেরেশতা জিবরাইল আ:কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা ওই সমস্ত লোক তারা তাদের ভাইয়ের গিবত করত এবং তাদের সম্মানহানি করত।’ (মুসনাদে আহমাদ-৩/২২৪, আবু দাউদ-৪৮৭৮)
ইসলাম ধর্মে ব্যক্তির মান-মর্যাদা সুরক্ষার বিষয়ে জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষাকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আমানত রক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো মুসলমান ভাইয়ের দৃষ্টিতে অপর মুসলমান ভাইয়ের দোষত্রুটি পরিলক্ষিত হলে, সে ক্ষেত্রে কতর্ব্য হলো ওই দোষত্রুটি গোপন করা, জনসম্মুখে প্রকাশ করে তাকে হেয় বা লাঞ্ছিত না করা। এ বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি হলো, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ মহানবী সা: বলেছেন, ‘এক মুমিন আরেক মুমিনের আয়না ও ভাই।’ (আবু দাউদ, হাদিস-৪৯১৮)
পরিশেষে আল্লাহপাক আমাদেরকে ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষা এবং ব্যক্তির মান-মর্যাদার আমানত রক্ষা করে অগণিত সাওয়াব হাসিল করার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com