সমস্ত প্রশংসা একমাত্র রব্বে কারিমের, যিনি আল-কুরআনকে নাজিল করেছেন তাঁর বান্দার ওপর যেন তিনি বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারেন। আমি আমার রবের প্রশংসা করছি এবং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যিনি আল-কুরআনকে সব বস্তুর বিশদ বর্ণনাকারী হিসেবে অবতীর্ণ করেছেন এবং হেদায়েত, রহমত ও মুমিন-মুসলমানদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়েছেন।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সা: তাঁর বান্দা ও রাসূল। যার আদর্শই মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। তিনি আল-কুরআনের বৈধকে হালাল হিসেবে ও আল-কুরআনের নিষিদ্ধকে হারাম হিসেবে জানতেন এবং কুরআনের নির্দেশিত আয়াতগুলোর ওপর আমল করতেন।
নবী সা:, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবিদের ওপর, যারা রাসূল সা: এবং পবিত্র কুরআনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন, তার নির্দেশনাবলিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তাদের ওপর শান্তি, রহমত ও বরকত নাজিল হোক।
অতঃপর হে মুসলিম ভাইসব! আপনারাই কুরআনের অনুসারী জাতি। আল্লাহ তায়ালার যথাযথ তাকওয়া অবলম্বন করুন। হে আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহ মুমিনদের ওপর অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন।
সেই সাথে তার ওপর শ্রেষ্ঠ কিতাব আল-কুরআন নাজিল করেছেন এমন শ্রেষ্ঠ জাতির জন্য যাদেরকে সব কিছুর কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই মহাগ্রন্থ আল-কুরআন তাদেরকে সরল ও সহজ এবং সঠিক পথের নির্দেশ করে। এই কুরআন তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যায়, ফিতনার সময় কুরআনই মুমিনের আশ্রয়স্থল ও তাদেরকে বিপদে উদ্ধারকারী।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! এই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে রয়েছে আপনাদের পূর্ববর্তীদের ইতিহাস, পরবর্তীদের সংবাদ এবং আপনাদের মাঝে সব ধরনের সিদ্ধান্তের বিধান, সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী, আল-কুরআন কোনো অহেতুক বিষয় নয়।
যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত আল-কুরআনকে ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার দাম্ভিকতাকে চূর্ণ করে দেন, আর যে ব্যক্তি আল-কুরআনকে বাদ দিয়ে সঠিক পথ খুঁজে, আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করে দেন। আল-কুরআন ছেড়ে দিয়ে যে সম্মান অন্বেষণ করে আল্লাহ তাকে অপদস্ত করেন। আর যে আল-কুরআনের দ্বারস্থ না হয়ে সাহায্য ও বিজয় কামনা করে সে আল্লাহ তায়ালার রোষানলে পতিত হয়।
আল-কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মজবুত রজ্জু, এটিই হচ্ছে সহজ ও সঠিক পথের দিশারি। আল-কুরআনের অনুসারী হলে কেউ বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট হবে না। আলেমরা কুরআন থেকে কখনোই তৃপ্ত হন না। অর্থাৎ আল-কুরআন যতই তারা তিলাওয়াত করেন ততই তাদের কাছে ভালো লাগে। আল-কুরআনের রহস্য ও নিগূঢ় তত্ত্বের কোনো শেষ নেই।
যে আল-কুরআনের কথা বলে সে তো সত্যই বলে, আর যিনি কুরআন মোতাবেক ফায়সালা করেন তিনি তো ইনসাফ করেন, আর যে আল-কুরআন অনুযায়ী আমল করে সে তো সওয়াব ও প্রতিদান লাভ করে, যে আল-কুরআনের দিকে আহ্বান করে সে অবশ্যই সরল ও হেদায়েতের পথে আহ্বান করে। যারা আল-কুরআন পাঠ করে ও সেই অনুযায়ী চলে তাদের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিয়েছেন যে, তারা দুনিয়াতে পথভ্রষ্ট হবে না এবং পরকালেও বিপদগ্রস্ত হবে না।
ইবনে আব্বাস রা:-এর বর্ণনায় এসেছে। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, ইহকাল ও পরকালে সে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুসলিম শরিফের হাদিস, রাসূল সা: বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কাছে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যা তোমরা আঁকড়ে ধরলে কখনোই পদচ্যুত হবে না, আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআন।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল করে আল্লাহ তার বান্দাদের অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব জাতি! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এমন বিষয় সমাগত হয়েছে যা হচ্ছে নসিহত এবং অন্তরের সব রোগের আরোগ্যকারী, আর মুমিনদের জন্য কুরআন পথ-প্রদর্শক ও রহমত। হে নবী, আপনি বলে দিন, আল্লাহর এই দান ও রহমতের প্রতি সবারই আনন্দিত হওয়া উচিত; আল-কুরআন (পার্থিব সম্পদ) থেকে বহুগুণে উত্তম যা তারা সঞ্চয় করছে’ (সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৭-৫৮)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘আপনার ওপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তা মুসলিমদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ’ (সূরা নাহল, আয়াত-৮৯)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘হে আহলে কিতাব! তোমাদের কাছে রাসূল এসেছে, যে তোমাদেরকে স্পষ্টভাবে (আল্লাহর হুকুম) বলে দিচ্ছেন, যাতে তোমরা বলতে না পারো যে, তোমাদের কাছে কোনো সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী আগমন করেনি। (এখন তো) তোমাদের কাছে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী এসে গেছে, আর আল্লাহ সব বস্তুর ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান’ (সূরা মায়িদা, আয়াত-১৯)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ এসেছে এবং তোমাদের প্রতি সমুজ্জ্বল জ্যোতি অবতীর্ণ করেছি। অতঃপর যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তাঁকে সুদৃঢ়রূপে ধারণ করেছে, ফলত তিনি তাদেরকে স্বীয় করুণা ও কল্যাণের দিকে প্রবিষ্ট করাবেন এবং স্বীয় সরল পথ প্রদর্শন করবেন’ (সূরা নিসা, আয়াত : ১৭৪-১৭৫)।
তিনি আরো বলেন, ‘এই কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ পথনির্দেশ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ বিশ্বাসীদের সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। আর যারা পরকাল বিশ্বাস করে না তাদের জন্য আমি প্রস্তুত করে রেখেছি মর্মন্তুদ শাস্তি’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৯-১০)। উপরোক্ত বিষয়ে আরো অনেক আয়াত রয়েছে যারা আল-কুরআন জেনে-বুঝে মনোযোগের সাথে তিলাওয়াত করে ও সে অনুযায়ী আমল করে তাদের এগুলো জানা রয়েছে। সালফে সালেহিনদের পদ্ধতি ছিল এমনÑ তারা কুরআনের আয়াত শিখলে তার অর্থ অনুধাবন ও আমল না করে সামনের দিকে অগ্রসর হতেন না। তারা ইলম ও আমল একত্রে শিখেছেন। যেমনটি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, কাজেই তারা কুরআনের আদেশ ও নিষেধ সংক্রান্ত জ্ঞানার্জন করেছেন এবং সে অনুযায়ী আমল করতে বিনা দ্বিধায় অগ্রগামী হয়েছেন।
হে মুসলিম ভাইয়েরা! আজ আমরা এমন এক জামানায় বাস করছি যেখানে নানাবিধ ফিতনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, বিপদ ও দুর্যোগের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে, প্রবৃত্তির লালসা তীব্রতর হচ্ছে, অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক বিষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিভিন্ন জটিলতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, অন্যায় ও বিদআতের দিকে আহ্বানকারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমতাবস্থায় এগুলো থেকে মুক্তি পেতে সত্যের ওপর সুদৃঢ় অবিচল থাকতে হবে।
মানসিক প্রশান্তি ও তৃপ্তি অর্জন করতে হলে, বাস্তবিক প্রতিদান ও পুরস্কার লাভ এবং শাস্তি থেকে নিরাপত্তা পেতে হলে, সঠিক আকিদার ওপর থাকতে হলে এবং সুনাম ও সুন্দর কর্ম চালিয়ে যেতে হলে, রাজা-প্রজা, জাতি-গোত্র, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, আলেম-সাধারণ সব মুসলিমকে যথাযথভাবে পূর্ণ আবেগ ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের তিলাওয়াত উপলব্ধি করা, তাঁর শিক্ষা দেয়া-নেয়া ও আমল করা এবং সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে আল-কুরআন পথেই ফিরে আসতে হবে।
আল-কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে বরকত কামনা করছি। আল্লাহ তায়ালা আপনাদেরকে এবং আমাকে আল-কুরআনের বরকত দান করুন এবং আল কুরআনের নিদর্শনাবলি গ্রহণ করে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ তায়ালা আমাকে এবং আপনাদের সবাইকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
(২৯ অক্টোবর ২০২১ মসজিদে নববীতে শায়খ আহমদ তালেব হামিদি হাফি. কর্তৃক প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ) অনুবাদক: ইসমাইল মাদানি, মদিনা মুনাওয়ার, সৌদি আরব