ভোলায় গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয় ১৯৯৫ সালে। এরপর সময় পেরিয়েছে আড়াই দশকেরও বেশি। এখনো এখান থেকে উত্তোলিত গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা যায়নি। স্থানীয় পর্যায়েও এখানকার বিপুল পরিমাণ মজুদের সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দেশে চলমান জ্বালানি সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এখন বড় এ মজুদ অব্যবহৃত থেকে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মূলত সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব এবং সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ভোলার গ্যাসের মজুদ কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ জ্বালানি-সংশ্লিষ্টদের। তাদের ভাষ্যমতে, ভোলার গ্যাস কাজে লাগানো সম্ভব হলে দেশে চলমান জ্বালানি সংকট অনেকটাই প্রশমন করা সম্ভব হতো।
দ্বীপ জেলা ভোলায় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তা কাজে লাগাতে নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। পাইপলাইন নির্মাণের মাধ্যমে খুলনা ও বরিশালের সঙ্গে ভোলার গ্যাস সংযোগ দেয়ার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছরেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। অন্যদিকে মজুদ ফুরিয়ে আসছে অন্যান্য স্থানে আবিষ্কৃত গ্যাসেরও। এ অবস্থায় পাইপলাইনের বিকল্প হিসেবে ভোলার গ্যাস এলএনজিতে (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) রূপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে জ্বালানি বিভাগ।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, ভোলার গ্যাস ব্যবহার করার জন্য দুটি পরিকল্পনা আমরা করেছি। প্রথমত, সেখানকার গ্যাস এলএনজিতে রূপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা। দ্বিতীয়ত, ভোলা থেকে ফেনী পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা। তবে প্রাথমিক সিদ্ধান্তে এলএনজিতে রূপান্তরের বিষয়টি বেশ ব্যয়বহুল। এটি নিয়ে আরো সমীক্ষা প্রয়োজন। ভোলার গ্যাস বৃহদাকারে কাজে লাগাতে দুভাবে কাজ চলছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাব। এরপর বলা যাবে, কোনটি আমাদের জন্য সহজলভ্য হবে। তবে আর্থিক কারণে এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেকটাই দুরূহ বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পাইপলাইনের বিকল্প হিসেবে এলএনজির পরিকল্পনা ব্যয়বহুল চিন্তা। ভোলায় যে পরিমাণ গ্যাস রয়েছে, তা দিয়ে এ ধরনের পরিকল্পনা করলে জ্বালানি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটিও সহজলভ্য নয়।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সুফী বলেন, ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে পাইপলাইন প্রকল্প সবচেয়ে বেশি লাভজনক। একে এলএনজিতে রূপান্তর করার পরিকল্পনা ভুল সিদ্ধান্ত হবে। কারণ এলএনজিতে রূপান্তর করতে হলে যে পরিমাণ গ্যাস ও বিনিয়োগ প্রয়োজন সেটি কোনোভাবেই এ গ্যাসক্ষেত্রের জন্য উপযোগী নয়। তার ভাষ্যে, কোনো গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসকে রিগ্যাসিফিকেশন করে এলএনজিতে রূপান্তর করতে হলে সেখানে অন্তত সাড়ে ৩ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন কিউবিট ফিট (টিসিএফ) গ্যাস প্রয়োজন। একই সঙ্গে এলএনজি রূপান্তর প্রকল্পে অন্তত ২ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। ভোলায় যে গ্যাস আছে, তাতে কোনোভাবেই এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলে বিনিয়োগ উঠে আসবে না।
অন্যদিকে আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম মনে করছেন, পাইপলাইন নির্মাণ করে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনা চ্যালেঞ্জিং ও ব্যয়বহুল বিনিয়োগ। তিনি বলেন, এ খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হবে, তাতে মজুদ গ্যাস উত্তোলন করে খরচ তুলে আনা কঠিন। ভোলায় যে পরিমাণ গ্যাস রয়েছে, তা পাইপলাইনে করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে হলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপলাইন করে তা থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে না। ১৯৯৫ সালে ভোলার শাহবাজপুরে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাপেক্স। বর্তমানে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে দেড়-দুই টিসিএফ গ্যাস রয়েছে বলে ধারণা করছে জ্বালানি বিভাগ।
বাপেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ভোলার বোরহানউদ্দিনের শাহবাজপুরে চারটি কূপ রয়েছে। এর বাইরে ‘শাহবাজপুর ইস্ট’ ও ‘ভোলা নর্থ’ নামে আরো দুটি কূপ রয়েছে। মোট ছয়টি কূপে প্রায় ১ দশমিক ৩ টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে শাহবাজপুর ইস্ট কূপে রয়েছে ৭০০ বিসিএফ (১ টিসিএফ=১০০০ বিসিএফ)। আর ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্রে রয়েছে প্রায় এক টিসিএফ গ্যাস। বর্তমানে ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক প্রায় ৬০ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এ গ্যাস সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প ও অন্তত দুই হাজার আবাসিকে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর বাইরেও ভোলায় নতুন করে তিনটি কূপ খনন করা হবে। এগুলো হলো ইলিশা-১, ভোলা নর্থ-২ ও টবগি-১। আগামী বছরের প্রথমেই কূপ তিনটির খনন শুরু হচ্ছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম এসব কূপ খনন করবে। বর্তমানে পাইপলাইন নির্মাণে ব্যয়ের দুশ্চিন্তা বাড়ালেও এ সংকট থেকে পরিত্রাণের সুযোগ আগেই পেয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। ভোলার গ্যাস বৃহদাকারে কাজে লাগাতে নব্বইয়ের দশকের জ্বালানি খাতের বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিকল পেট্রোবাংলাকে পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। ৭০০ মিলিয়ন ডলারের ওই প্রস্তাবে ১২০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। একই সঙ্গে ভোলা থেকে উত্তোলিত গ্যাস ব্যবহার করে বরিশালে ১০০ মেগাওয়াট, খুলনায় ৩৫০ ও ভোলায় ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল কোম্পানিটি। ওয়েস্টার্ন রিজিয়ন ইন্টিগ্রেটেড প্রজেক্টের (ডব্লিউআরআইপি) আওতায় দেয়া প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে বর্তমানে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পাশাপাশি দেশের দক্ষিণাঞ্চলকেও আরো অনেক আগেই গ্যাস নেটওয়ার্কের আওতায় আনা যেত।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের সাবেক এক কর্মকর্তার বক্তব্য হলো ভোলার গ্যাস কাজে লাগাতে ইউনিকল যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটি গ্রহণ করলে দেশে গ্যাসের এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। মূলত সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ভোলাকে অকেজো করে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর।প্রসঙ্গত, ১৯৫৯ সালে জরিপ করে ভোলার শাহবাজপুরকে সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই সময় পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি সিঙ্গেল কনডাক্টেড টুডি সিসমিক জরিপ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪-৭৫ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকৃত সিসমিক জরিপ করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ের জরিপ হয় ১৯৮৭ সালে। ২০১৪-১৫ সালে বাপেক্সের তত্ত্বাবধানে ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় থ্রিডি সিসমিক জরিপ করে দুটি আলাদা গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়।-বণিকবার্তা