বিশেষ সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
[ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা, সরকারের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। সরকারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতার অভাবেই বাজার পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠছে বলে মত তার। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গড়ে তোলারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কাকে কে দোষ দেবে? সরকার নিজেই তো জ্বালানির দাম বাড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। জ্বালানি, বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব জিনিসের দাম বাড়বেই। অনেকে সুযোগও নেবে। যেমন পরিবহন সেক্টর সুযোগ নিয়ে থাকে বরাবরই। জবাবদিহি না থাকলে নানা পক্ষ কারসাজি করার সুযোগ পায়। যারা কারাসাজি করছে, তাদের সরকারও চেনে । সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। জাগোনিউজের সৌজন্যে দৈনিক খবরপত্রের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি পত্রস্থ করা হলো।-বার্তা সম্পাদক ]
জিজ্ঞাসা: বেসামাল বাজার পরিস্থিতি । হাহাকার সর্বত্রই। বিশেষ করে নি¤œ-নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষ এখন দিশেহারা প্রায়। বাজারের এই চিত্র অবশ্যই আপনার নজরে আছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: সাধারণ মানুষ যে নিদারুণ কষ্টে আছে, তা যে কেউ-ই অনুধাবন করতে পারেন। ফুড, নন-ফুড সব ধরনের পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এমন কি মধ্যবিত্তরাও এখন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ভয়াবহভাবে।
মানুষ বেঁচে থাকার জন্য নির্দিষ্ট বাজেট সঞ্চয় করে রাখে বা রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। বাজারে গিয়ে মানুষ দিশেহারা। সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে। মানুষ ভবিষ্যতের জন্য কোনো সঞ্চয় করে রাখতে পারছে না। এমন পরিস্থিতি দেশ, দেশের মানুষের জন্য কোনোভাবেই শুভ হতে পারে না।
জিজ্ঞাসা: করোনার অভিশাপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করলো…?
মানুষ সয়ে নিচ্ছে মানেই সুখে আছে এমন নয়। অভিযোগ দিয়েও লাভ নেই। প্রতিটি মানুষ মানসিক চাপে আছে। আয় কমে যাওয়ায় সামাজিক চাপটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সামাজিকভাবে চাপ প্রয়োগ করবে, তা করে না
সালাহউদ্দিন আহমেদ: করোনার প্রভাব এখনো রয়েছে। সামনে কী ঘটবে তা বলা মুশকিল। মানুষের আয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকের আয় কমে গেছে। অনেকে সকতর্কতা অবলম্বন করছেন। চাহিদাও কমিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। সাধারণত, বাজারে যখন সরবরাহ একদম থাকে না তখন চাহিদা বেড়ে যায়। আবার সরবরাহ একটু কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। বাজারে জিনিসপত্র আছে। গুদামে যেটা আছে সেটাও কম নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু মানুষের হাতে পৌঁছাচ্ছে না।
অতএব প্রথমত এই সরবরাহের দিকটা দেখতে হবে। যেখানে পণ্য তৈরি হয় এবং সেখান থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর মাঝখানে অনেকগুলো লোক থাকে। পরিবহন খরচ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি পার হয়ে খুচরা বাজারে এসে পৌঁছায়। খুচরা বাজারে যারা বিক্রি করে তারা আগেই হোল সেলারদের সঙ্গে আঁতাত করে দাম বাড়িয়ে দেয়। তারপর এটা আপনার হাতে আসে। এই চেইন থেকেই পণ্যের দাম আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না। রাজনীতিকরা মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন। আবার রাজনীতিক ব্যক্তিরা আপনার সহনশীলতারও সুযোগ নিচ্ছেন। সহনশীলতা মানেই যে লোকে আপনাকে পছন্দ করে তা তো না। কারণ সহনশীলতা মানে ভদ্রভাবে তারা এটা সয়ে নিচ্ছে। বাইরের দেশে এমন হলে আন্দোলন হয়। আন্দোলন করার অধিকার পায়। বাংলাদেশে তো অধিকার নিয়ে মানুষ মাঠে নামতে পারছে না। অদ্ভুত ব্যাপার
জিজ্ঞাসা: আপনি মধ্যসত্বভোগীদের কথা বলছেন। জনসংখ্যাও বাড়ছে। করোনার হানাও সবকিছু পাল্টে দিচ্ছে। আসলে দ্রব্যমূল্যের এই পরিস্থিতিতে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া যায়?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: জনসংখ্যা বৃদ্ধি তো হঠাৎ করে হয় না। গত ছয় মাসে কতজন মানুষ বেড়েছে? পণ্য উৎপাদন তো একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। করোনার মধ্যে উৎপাদন অব্যাহত আছে।
মূলে যেতে হবে আমাদের। মূলত, বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে নেই। পেঁয়াজের দাম থেকেই আপনি সব বুঝতে পারবেন। কারসাজির মাধ্যমেই দ্রব্যমূল্য বেশি বাড়ানো হয়। এখানে সবচেয়ে ব্যর্থতা হলো বাজার নজরদারিতে। নজরদারিতে দায়িত্বে থাকা পণ্য করপোরেশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তাদের ব্যর্থতার কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
জিজ্ঞাসা: তার মানে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জনদায় আর…
সালেহউদ্দিন আহমেদ: না, নিয়ন্ত্রণক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জনদায় আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। এখানে তো আর জবাবদিহি বলতে কিছু নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী বা ভোক্তা সংরক্ষণ আইন অথবা যারা মনিটর করছে বা যারা রাস্তায় পাহারা দিচ্ছে, ঠিক কারও মধ্যেই দায়বদ্ধতা নেই। কাকে কে দোষ দেবে? সরকার নিজেই তো জ্বালানির দাম বাড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। জ্বালানি, বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব জিনিসের দাম বাড়বেই। অনেকে সুযোগও নেবে। যেমন পরিবহন সেক্টর সুযোগ নিয়ে থাকে বরাবরই। জবাবদিহি না থাকলে নানা পক্ষ কারসাজি করার সুযোগ পায়। যারা কারাসাজি করছে, তাদের সরকারও চেনে।
জিজ্ঞাসা: সাধারণের মানুষের কষ্টের কথা বলছিলেন। সরকারের খাদ্যমন্ত্রী কিন্তু বলেছেন, দ্রব্যমূল্য বাড়লেও মানুষের মধ্যে এক ধরনের সহনীয় মাত্রা আছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে বলেও তার দাবি।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: এটি রাজনৈতিক ভাষা। মানুষ সয়ে নিচ্ছে মানেই সুখে আছে এমন নয়। অভিযোগ দিয়েও লাভ নেই। প্রতিটি মানুষ মানসিক চাপে আছে। আয় কমে যাওয়ায় সামাজিক চাপটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সামাজিকভাবে চাপ প্রয়োগ করবে, তা করে না। রাজনীতিকরা মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন। আবার রাজনীতিক ব্যক্তিরা আপনার সহনশীলতারও সুযোগ নিচ্ছেন। সহনশীলতা মানেই যে লোকে আপনাকে পছন্দ করে তা তো না। কারণ সহনশীলতা মানে ভদ্রভাবে তারা এটা সয়ে নিচ্ছে। বাইরের দেশে এমন হলে আন্দোলন হয়। আন্দোলন করার অধিকার পায়। বাংলাদেশে তো অধিকার নিয়ে মানুষ মাঠে নামতে পারছে না। অদ্ভুত ব্যাপার।