শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৫ পূর্বাহ্ন

বিটিএমসি মিল নেই, কাজ নেই, বসে বসে লোকসান

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১

নিজেদের হাতে কোনো সচল কারখানা নেই। তেমন কোনো কাজও নেই। কিন্তু জনবল আছে ১০৪ জন। এই জনবলকে বেতন–ভাতা দিতে গিয়ে বছর বছর লোকসান দিতে হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে। এ অবস্থা বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি), যাদের হাতে একসময় ৮৬টি কারখানা ছিল। এই করপোরেশনই স্বাধীনতা–পরবর্তী দেশের সুতা ও বস্ত্রের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করত। স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে দেশের সুতা ও বস্ত্র খাত ব্যাপকভাবে এগিয়েছে। যদিও তা বেসরকারি খাতের হাত ধরে। বিপরীতে সরকারি বস্ত্রকলগুলো রুগ্ণ হয়েছে। বেসরকারি খাতের বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) আশা করছে, এ বছর তারা ২ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের (২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা) পণ্য রপ্তানি করতে পারবে।
বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, বিটিএমসি এখন তাদের কারখানাগুলোর জমিতে ছোট ছোট অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে পারে। অথবা জমি বিক্রি করে দিতে পারে। যন্ত্রপাতি পুরোনো লোহা হিসেবে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই।
ফিরে দেখা: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কিছু বস্ত্রকল করা হয়েছিল। এর একটি কারণ হলো কম মজুরিতে শ্রমিকের প্রাপ্যতা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ শিল্প প্রতিষ্ঠান (রাষ্ট্রীয়করণ) আদেশের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় বিটিএমসি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ১ জুলাই জাতীয়করণ করা ৭৪টি কারখানা নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে বিটিএমসি। পরে তারা আরও ১২টি কারখানা স্থাপন করে। পরের ইতিহাস অবশ্য করপোরেশনটির পিছিয়ে যাওয়ার। বিরাষ্ট্রীয়করণ ও বেসরকারীকরণ নীতির আওতায় এবং লোকসান দেওয়ার কারণে ১৯৭৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ৫৮টি কারখানা বিক্রি, হস্তান্তর ও অবসায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। এখন বিটিএমসির হাতে আছে ২৮টি কারখানা। যার মধ্যে বন্ধ ২১টি, ভাড়া দেওয়া ২টি, সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেওয়া দুটি (চুক্তি সই হয়েছে) এবং নামসর্বস্ব তিনটি। বিটিএমসির প্রধান কার্যালয় ঢাকার কারওয়ান বাজারে। এ কার্যালয়ে ১০৪ জনের লোকবল রয়েছে, যার মধ্যে ৪২ জন প্রথম শ্রেণির। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা বাবদ বছরে ব্যয় সাত কোটি টাকার বেশি।
বিটিএমসির প্রধান কার্যালয়ের নিজস্ব ভবনটি ১১ তলা। এ কার্যালয়ের একটি তলা এবং আরেকটি অর্ধেক ছাড়া বাকিটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিটিএমসি সূত্র জানিয়েছে, কর্মকর্তা–কর্মচারীরা অফিসে যান মূলত হাজিরা দিতে। অফিসে গিয়ে তাঁরা গল্পগুজব করে সময় কাটান। বিটিএমসির ইনচার্জ (বাণিজ্য) ও পিপিপি প্রকল্পগুলোর পরিচালক কাজী ফিরোজ হোসেন বলেন, এত দিন বিটিএমসির কোনো কার্যক্রম ছিল না বললেই চলে। পিপিপির আওতায় বিটিএমসির ১৬টি কারখানা দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুটির চুক্তি সই হয়েছে। তিনি বলেন, কারখানাগুলো চালু হলে বৃহৎ আকারে বিটিএমসির কার্যক্রম শুরু হবে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা পাটকল ও বস্ত্রকল পিপিপির অধীনে চালাতে একটি সেল থাকাই যথেষ্ট। বিটিএমসির সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, কারখানা পিপিপিতে দিলে তা তদারকির জন্য একটি প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। সরকার তাই বিটিএমসিকে পুনর্গঠন করতে পারে।

‘বেকারের’ লোকসান: বিটিএমসি এখন আয় করে মূলত নিজেদের প্রধান কার্যালয়ের ভবন ভাড়া দিয়ে। আর কারখানা ভাড়া থেকে কিছু অর্থ আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাবে, বিটিএমসির মোট ব্যয় ছিল ২৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর আয় ছিল ২০ কোটি টাকার কিছু কম। বার্ষিক প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, বিটিএমসি সর্বশেষ চার অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকার বেশি। বিটিএমসিকে বসিয়ে বসিয়ে লোকসান দেওয়ার যৌক্তিকতা কী, তা জানতে চেয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ৭ নভেম্বর ই–মেইল করা হয়। যদিও উত্তর গতকাল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ই–মেইলের উত্তর দেননি বিটিএমসির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাকির হোসেনও।
জমি বেদখল: বিটিএমসির বিপুল জমি রয়েছে। কারখানা, প্রধান কার্যালয় ও ঢাকার হাটখোলার সম্পত্তি মিলিয়ে তাদের জমি ৬৫২ একরের বেশি। এর মধ্যে সাভারের আফসার কটন মিলের জমির পরিমাণ ৫ দশমিক ৫২ একর। নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১ দশমিক ৫৩ একর জমি। বাকি প্রায় চার একর বেদখল। সরেজমিন গত ২৪ অক্টোবর দেখা যায়, আফসার কটন মিলের মূল ভবন ছাড়া বাকি সব জমি অন্যের দখলে। মিলের বিপরীত পাশে ছিল শ্রমিকদের কোয়ার্টার। সেই কোয়ার্টার ভেঙে নতুন আবাসিক ভবন করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। বিটিএমসির পিপিপি প্রকল্পের পরিচালক কাজী ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘এ কারখানার জমিতে ১০০টির বেশি ভবন গড়ে উঠেছে। ১ দশমিক ৫৩ একর জমি আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। কারখানাটি নিয়ে এখনো মামলা চলছে। বিটিএমসির পক্ষে রায় এলে আমরা বাকি জমি উদ্ধারের চেষ্টা করব।’ রাজধানীর সূত্রাপুর মৌজার হাটখোলায় বিটিএমসির সোয়া চার একর জমি রয়েছে। ২০১১ সালের জুলাইয়ে সেই জমি উদ্ধারে অভিযান চালায় বিটিএমসি। এখন পর্যন্ত তারা দুই একরের কিছু বেশি উদ্ধার করতে পেরেছে। সেখানে একসময় বসবাসকারী বিটিএমসি কর্মকর্তারাই জমি বেদখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পিপিপিতে দুই কারখানা: ২৫টির মধ্যে ১৬টি কারখানা পিপিপির আওতায় চালুর অনুমতি পেয়েছে বিটিএমসি। এর মধ্যে গাজীপুরের টঙ্গীর কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিল ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এবং রাজধানীর ডেমরার আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিল ২০১৯ সালের জুনে বিটিএমসি পিপিপির আওতায় দিতে দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী, তানজিনা ফ্যাশন লিমিটেড নিয়েছে আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিল। আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিলে গত ৩১ অক্টোবর গিয়ে দেখা যায়, কারখানার একটি অংশে বস্ত্র উৎপাদন করে তানজিনা ফ্যাশন। বাওয়ানী টেক্সটাইল মিল পিপিপির আওতায় উৎপাদনে গেছে বলে জানান তানজিনা ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসানুল মুজিব।
ভাড়ায় কেমন চলছে: ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় তাঁর দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী চারটি বন্ধ মিল ভাড়া দিয়ে চালু করা হয়। ২০১৮ সালে গিয়ে ভাড়ায় চালিত বিটিএমসির মিলের সংখ্যা দাঁড়ায় আটটিতে। তবে সর্বশেষ হিসাবে, আটটির মধ্যে ছয়টি মিলের ভাড়া বাতিল হয়েছে। সেগুলো অলস পড়ে রয়েছে।

বিটিএমসির কাছ থেকে মিল ভাড়া নিয়ে চালানোর অভিজ্ঞতাও সুখকর নয় ব্যবসায়ীদের কাছে। যেমন বছরখানেক আগে রাজশাহী টেক্সটাইল মিলের ভাড়া ছেড়ে দেয় নারায়ণগঞ্জের মোবারক ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোবারক সরকার বলেন, কারখানাটিতে বিদ্যুতের যে সংযোগ ছিল, তা ছিল অত্যন্ত বেশি ক্ষমতার। এতে বিল অনেক বেশি আসত। বিটিএমসিকে বারবার চিঠি দিয়ে বিদ্যুতের কম ক্ষমতার সংযোগ পাইয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তারা সেটা করেনি। মোবারক সরকার বলেন, ‘বছরখানেক আগে আমি কারখানা ছেড়ে দিই। এরপর বিটিএমসির কারখানাটিতে কম ক্ষমতার বিদ্যুৎ–সংযোগ নিয়েছে। তবে সেটি এখন অলস পড়ে আছে।’ বিটিএমসির নিয়ন্ত্রণে থাকা মিলগুলোর মধ্যে দুটি এখন ভাড়ায় চলছে। এর মধ্যে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ার বেঙ্গল টেক্সটাইল মিল মাসে ২ লাখ ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের আর কে ইয়ার্ন ট্রেডিং। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী গোপাল চন্দ্র সাহা বলেন, যশোরে শ্রমিকসংকটের কারণে এখন আর লাভ হচ্ছে না।
মিল বন্ধ, জমি ভাড়া: বিটিএমসির নয়টি মিল এখন পর্যন্ত শ্রমিক–কর্মচারীদের কাছে হস্তান্তর করেছে সরকার। এর কিছু আংশিক চালু আছে, কিছু পুরো বন্ধ হয়ে গেছে। গাজীপুরের চারটির মধ্যে মন্নু টেক্সটাইল মিল একদম বন্ধ হয়ে গেছে এবং মেঘনা ও অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিল আংশিক চালু আছে। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কাছে হস্তান্তর করা রাজধানীর পোস্তগোলায় অবস্থিত ঢাকা কটন মিলও বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা কটন মিলে গত ২৩ অক্টোবর গিয়ে দেখা যায়, কারখানার উৎপাদন বন্ধ। সুতা উৎপাদনের যন্ত্রগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। কারখানা ভবনের ছাউনির টিনগুলো জীর্ণ হয়ে খসে পড়ছে। যন্ত্রপাতির ওপর লতাপাতা গজিয়েছে। কারখানার বিভিন্ন অংশ ও গুদাম ভাড়া দেওয়া।
দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জানান, কারখানার জমি ও স্থাপনার বড় অংশ আসবাব কারখানা, গ্রিলের ওয়ার্কশপ, গুদাম, রিকশার গ্যারেজসহ ২৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ঢাকা কটন মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন বলেন, ২০০১ সালে এ কারখানা কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দেওয়া হয়। এরপর দুই বছরের মতো সময় সুতা উৎপাদন হয়েছিল। সুতা উৎপাদন লাভজনক না হওয়া ও বিনিয়োগকারী না পাওয়ায় কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, প্রায় ১২ বছর অলস পড়ে থাকার পর বিদ্যুৎ ও পানির বিল এবং কর ব্যয় মেটাতে ২০১৫ সাল থেকে কারখানাটি ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
‘মাথাভারী প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করতে হবে’:সরকারের যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, তার বেশির ভাগই লোকসানি। কোনো কোনোটি একেবারেই রুগ্ণ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করে করেন, দুর্নীতি, সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারা, যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন না করা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষতাসহ নানা কারণে সরকারি ব্যবসা বেসরকারি খাতের মতো এগিয়ে যেতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব যাঁদের দেওয়া হয়, তাঁদের লোকসানের কোনো দায় থাকে না। তাঁরা মূলত চাকরি করেন, প্রতিষ্ঠান এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য তাঁদের থাকে না।

বিটিএমসির মতো বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনেরও (বিজেএমসি) এখন তেমন কাজ নেই। গত বছর জুলাইয়ে তাঁদের অধীনে থাকা ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও করপোরেশনটিতে প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তা–কর্মচারী রয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিটিএমসিকে অপ্রয়োজনীয় মাথাভারী প্রতিষ্ঠান করে রাখা হয়েছে। আমলাদের জন্য অর্থ খরচ, বিলাসিতা, বিদেশ সফরÍসবকিছুই হচ্ছে। অথচ তাঁদের কোনো কাজ নেই। এটা একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি। তিনি মনে করেন, বিটিএমসিকে হয় তার অধীনে থাকা কারখানাগুলো সচল করতে হবে, অথবা এ ধরনের মাথাভারী প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করতে হবে। অযথা জনগণের টাকা আমলাদের পেছনে খরচের অর্থ হয় না।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com