৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবস। গোপালগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গৌরবের দিন। ১৯৭১ সালের এ দিনে গোপালগঞ্জ শহর পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল। এই দিনটি গোপালগঞ্জ বাসীর কাছে আজও তাই স্মরণীয় ঘটনা, শ্রেষ্ঠ এক স্মৃতি। আনন্দ আর উৎসবের দিন। এই দিনে সূর্য ওঠার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করেন। হাতে তাদের উদ্যত রাইফেল ও বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত রক্ত লাল সূর্য সম্বলিত গাঢ় সবুজ জমিনের পতাকা। মুখে বিজয়ের হাঁসি। আজ আর শহরে হানাদার বাহিনী নেই। আজ এ শহর মুক্ত। আজ এ শহর সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের দখলে। এ যেন শৃঙ্খল মোচনের সুপ্রভাত। এ যেন মুক্তির অনাবিল সুখ। ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল গোপালগঞ্জে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে মুক্তিকামী মানুষের উপর নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ করে। উপজেলা পরিষদে (পদ্মপুকুর পাড়ে) মিনি ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করে পাকবাহিনী শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকদের হত্যা করে লাশ পদ্মপুকুরে ফেলে রাখত। এ কান্টনমেন্ট থেকে জেলার বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ করত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে গোপালগঞ্জের মিনি ক্যান্টনমেন্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। টিকতে না পেরে ৬ ডিসেম্বর রাতে পাক সেনারা মিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে ভাটিয়াপাড়া ক্যান্টমেন্টে আশ্রয় নেয়। ফলে গোপালগঞ্জ ৬ ডিসেম্বর রাতেই শত্রু মুক্ত হয়। গোপালগঞ্জ, মাঝিগাতী, সুকতাইল, বৌলতলী, সাতপাড়সহ বিভিন্নস্থানে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধহয়। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লগ্নে মিত্র দেশ ভারত প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করায় হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মিনি ক্যান্টনমেন্টে হামলার পরিকল্পনা করে চারদিক থেকে আক্রমন বলয় রচনা করে। খবর পেয়ে পাক সেনারা ৬ ডিসেম্বর রাতেই গোপালগঞ্জ সদর থানা পরিষদ সংলগ্ন জয়বাংলা পুকুর পাড়ের মিনি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। মেজর সেলিমের অধীনে হানাদার বাহিনীর একটি দল ঢাকা ও অন্য একটি দল ভাটিয়াপাড়ার ওয়ারওলস ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ দিন তাই পরম পাওয়ার একটি দিন। শত দুঃখ কষ্ট ও আত্মত্যাগের পর বিজয়ের আনন্দঘন এক মুহুর্ত। পাক সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়েছে আর মুক্তিযোদ্ধারা শহরের দিকে আসছে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিকামী জনতার মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শহরের মুক্তিকামী মানুষ বেরিয়ে আসেন। সূর্যোদয়ের মতো আভা ছড়িয়ে বিস্তৃত করেছিল দিক দিগন্ত। শহরবাসী মেতে উঠেছিল অসীম আনন্দ উৎসবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান আজো অম্লান হয়ে আছে। আজো এসব বীর সেনানীর মনে শ্রেষ্ঠ স্মৃতি ও উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছে এই মুক্তিযুদ্ধ। ৭ ডিসেম্বর শহর হানাদার মুক্ত দিবস এলেই মুক্তিযুদ্ধের এসব বীর সৈনিকেরা মুখর হয়ে ওঠেন স্মৃতিচারণায়। ফিরে যান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় দিন গুলোতে। রনাঙ্গনের সেই ভয়াল স্মৃতি, যুদ্ধদিনের বিবরণ ও গৌরবময় বীরত্বগাথা স্মরণ করে হয়ে ওঠেন গর্বিত। এ বছরও নানান আয়োজন আর বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করা হবে গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবস। শহরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিসের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই দিন সকালে ৭১ এর বধ্যভূমি (জয়বাংলা পুকুর পাড়) স্মৃতি সৌধ ও শেখ কামাল স্টেডিয়ামের সম্মূখের মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভে জেলা প্রশাসন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সকালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে। বিকাল ৩ টায় শহরের শেখ ফজলুল হক মনি স্টেডিয়ামে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।