শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১০:০৪ পূর্বাহ্ন

কম তরঙ্গের কারণেই গ্রাহকরা মান-সম্মত সেবা বঞ্চিত

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২১

সংসদীয় কমিটির কাছে প্রতিবেদন বিটিআরসির

সা¤প্রতিক সময়ে সেলফোন যোগাযোগ সেবায় কলড্রপ ও দুর্বল নেটওয়ার্কের মতো সমস্যাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রকট হয়ে উঠেছে। দুর্মূল্য ও মানহীনতার অভিযোগ রয়েছে মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবা নিয়েও। এসব সমস্যা প্রকট করে তোলার ক্ষেত্রে অপ্রতুল তরঙ্গ বরাদ্দকে দায়ী করছেন টেলিকম খাতসংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি স্বীকার করছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি)। জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সর্বশেষ সভায় এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও দিয়েছে বিটিআরসি। এতে উঠে এসেছে, প্রতি মিলিয়ন (১ মিলিয়ন = ১০ লাখ) গ্রাহকের বিপরীতে অপারেটরদের জন্য বরাদ্দকৃত তরঙ্গের হিসাবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে নিচের দিকে।
স্পেকট্রাম বা তরঙ্গকে বলা হয় টেলিযোগাযোগ সেবার মূল চালিকাশক্তি। মানসম্মত টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানের পথে অন্যতম বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তরঙ্গস্বল্পতাকে। কিন্তু এখনো গ্রাহক সংখ্যার বিপরীতে অপারেটরদের জন্য বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণের দিক থেকে তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেনি বাংলাদেশ। কভিডজনিত স্থবিরতার কারণে গত দুই বছরেও এদিক থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। যদিও সেলফোন সেবার গ্রাহকদের মধ্যে এখন ভয়েস ও ডাটা ব্যবহার চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপারেটরদের জন্য অপ্রতুল তরঙ্গ বরাদ্দসহ আরো বেশকিছু কারণে গ্রাহকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধানও বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।
সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিটিআরসি উত্থাপিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে জনঘনত্ব অনেক বেশি হলেও এর বিপরীতে সেলফোন অপারেটরদের জন্য বরাদ্দকৃত স্পেকট্রাম অনেক কম। এতে মানসম্মত ও গতিশীল মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রাহক। দেশে প্রতি মিলিয়ন গ্রাহকের জন্য অপারেটরদের অনুকূলে বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণ দশমিক ৮৯ মেগাহার্টজ। যদিও আরো অনেক কম জনঘনত্বের দেশ কম্বোডিয়ায় এর পরিমাণ ১৩ দশমিক ৯৮ মেগাহার্টজ। এছাড়া প্রতি মিলিয়ন গ্রাহকের বিপরীতে ইন্দোনেশিয়ায় দশমিক ৭৭ মেগাহার্টজ, মালয়েশিয়ায় ৯ দশমিক ৪৯, নেপালে ২ দশমিক ৯৪ ও শ্রীলংকায় ১০ দশমিক ৮১ মেগাহার্টজ তরঙ্গ অপারেটরদের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির বক্তব্য হলো সেলফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মানসম্মত টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানের জন্য তরঙ্গের সর্বোত্তম ব্যবহার খুবই জরুরি। এজন্য গ্রাহক আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার বিবেচনায় প্রত্যেক অপারেটরের অনুকূলে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরঙ্গ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। এর ভিত্তিতে সেলফোন অপারেটরদের জন্য নতুন করে ২ হাজার ৩০০ মেগাহার্টজ বা আড়াই হাজার মেগাহার্টজ অথবা ৩ হাজার ৫০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড থেকে তরঙ্গ বরাদ্দের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে বিটিআরসি। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে সেলফোন নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রাহক সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে গ্রামীণফোন লিমিটেড। ৮৩ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন গ্রাহকের বিপরীতে কোম্পানিটির জন্য বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণ ৪৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ। রবি আজিয়াটা লিমিটেডের ৫৩ দশমিক শূন্য ৪ মিলিয়ন গ্রাহকের বিপরীতে বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণ ৪৪ মেগাহার্টজ। বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেডের ৩৭ দশমিক শূন্য ২ মিলিয়ন গ্রাহকের বিপরীতে তরঙ্গের পরিমাণ ৪০ মেগাহার্টজ ও টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের ৬ দশমিক ৪১ মিলিয়ন গ্রাহকের বিপরীতে বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণ ২৫ দশমিক ২ মেগাহার্টজ। তরঙ্গ বরাদ্দের পরিমাণ আরো বাড়ানো হলে গ্রাহকদের উন্নততর সেবা দেয়া সম্ভব হবে বলে দাবি করছে সেলফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি আংকিত সুরেকা এ বিষয়ে বলেন, আমরা মনে করি, বাংলাদেশে তরঙ্গের মূল্য পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু তরঙ্গের সঠিক বণ্টন ও পাশাপাশি অপারেটরদের অ্যাকটিভ শেয়ারিংয়ের অনুমতি দেয়া হলে গ্রাহকদের আরো উন্নত সেবা দেয়া সম্ভব।
২০০১ সালে প্রণীত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনের ৫৫ ও ৫৬ ধারার ভিত্তিতে ২০০২ সাল থেকে তরঙ্গ বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিটিআরসি। আইনের ৫৫ ধারায় বলা আাাছে, তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়ার একক এখতিয়ার কমিশনের। বিটিআরসির অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ ভূখ-ে কেউ তরঙ্গ ব্যবহার করতে পারবে না। এছাড়া ৫৬ ধারায় তরঙ্গ ব্যবস্থাপনার জন্য স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ ধারার ভিত্তিতে বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনারকে প্রধান করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনটি ২০১০ সালে সংশোধন করা হলেও তাতে তরঙ্গ বরাদ্দ প্রদানের প্রক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রযুক্তি অনুযায়ী তরঙ্গের ব্যবহার ব্যাপক, যা ব্যান্ডের কারিগরি বৈশিষ্ট্য ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। সরকারি, বেসরকারি গবেষণা ও বাণিজ্যিক নানা ক্ষেত্রে তরঙ্গের ব্যবহার করা হয়। তরঙ্গের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য বিভিন্ন মানদ-ও নির্ধারিত রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) নির্দেশনা ও দেশের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে ২০০৫ সালে ন্যাশনাল ফ্রিকোয়েন্সি অ্যালোকেশন প্ল্যান (এনএফএপি) প্রণয়ন করে বিটিআরসি।
এ পরিকল্পনার আলোকেই বিভিন্ন সেবার জন্য প্রয়োজনীয় তরঙ্গ বরাদ্দ দেয় বিটিআরসি। এক্ষেত্রে তরঙ্গ বরাদ্দের আবেদন পাওয়ার পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়। কমিটি তরঙ্গ বরাদ্দের সুপারিশ করলে তা কমিশনের সভায় উপস্থাপন করা হয়। সেখানে অনুমোদন পেলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ছাড়পত্র গ্রহণ এবং ফি বা চার্জ পরিশোধের পর তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে, তা সত্যই বলা হয়েছে। আমরা তলানির দিকে আছি। তরঙ্গ বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে আগামী মার্চে আমরা আরেকটি অকশন চালু করব।
এদিকে সরকার গত এক দশকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের দাম কমিয়েছে প্রায় শতভাগ। তার পরও সেলফোন অপারেটরদের কাছ থেকে এ সেবা সুলভ মূল্যে পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। বিস্তর অভিযোগ রয়েছে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি নিয়েও। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাটাভিত্তিক সেবার মূল অনুষঙ্গ ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ। তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়ে নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে গ্রাহক পর্যায়ে। সরকার ব্যান্ডউইডথের মূল্য যেভাবে কমিয়েছে, সে অনুযায়ী গ্রাহকের কাছে সুলভ হয়নি সেবাটি।
যদিও অপারেটরদের দাবি, ডাটা সেবার মূল্য আগের তুলনায় কমিয়েছে তারা। তবে উচ্চমূল্যে তরঙ্গ কিনতে হওয়ায় ব্যান্ডউইডথের মূল্য কমানোর প্রভাব সেভাবে পড়ছে না। ডাটা সেবাদানের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশের বেশি চলে যায় পরিচালন ব্যয়ে। আর বাকিটুকু ব্যয় হয় ব্যান্ডউইডথের পেছনে।
দামে বেশি হলেও বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট সেবার গতি ও মান এখনো বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। ডাটা সেবার গতি পরিমাপক মার্কিন সংস্থা ওকলার তথ্যমতে, বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে গতি বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। গত বছরের জানুয়ারিতে ১৩১তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এদিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে শুধু আফগানিস্তান। মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। ভারতে সেবাটির গতি বৈশ্বিক গড়ের কাছাকাছি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ বলেন, বাংলাদেশ দুনিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর অন্যতম। তাই এখানে অল্প এলাকার মধ্যে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বেশি। অন্যদিকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গের পরিমাণ সারা দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ। ফলে এখানে মেগাহার্টজ অনুপাতে গ্রাহকের সংখ্যা বেশি। সরকার এ পর্যন্ত যতবার তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়েছে, অপারেটররা তা ততবারই কিনেছে। যদিও আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে এর দাম অত্যন্ত বেশি। চলতি বছরের প্রথমার্ধে নিলামে ওঠা সব তরঙ্গই বিক্রি হয়ে যায়। ফলে এখন ৯০০, ১৮০০ ও ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে আর কোনো অব্যবহূত তরঙ্গ নেই। ভালো সংবাদ হলো যে সরকার ও বিটিআরসি আবারো অন্য কয়েকটি ব্যান্ডে তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়ার পরিকল্পনা করছে। সে নিলাম সফল হলে আশা করি তরঙ্গ অনুপাতে গ্রাহকের সংখ্যা কমে আসবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com