শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৮:২৪ পূর্বাহ্ন

 ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব 

সাদেক মাহমুদ পাভেল:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২১

বেনজীর ও র‌্যাবের ডিজিসহ ৭ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা 

পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদ ও কয়েকজন র‌্যাব কর্মকর্তার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় বাংলাদেশ অসন্তোষ জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারকে গতকাল শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এই অসন্তোষের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। খবরবিবিসি’র। ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সকালে আমরা ডেকে নিয়েছি। আমার পররাষ্ট্র সচিব আলোচনা করেছেন। উনিও অনেকটা সারপ্রাইজের মতো যে এরকম হয়েছে,’ মন্ত্রী শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন। এ সময় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ মোমেন তার সাথেই ছিলেন, তবে এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারের কাছে পুলিশ ও র‌্যাব প্রধানের ওপর দেয়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশের অসন্তুষ্টি জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, রাষ্ট্রদূত মিলার বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগ তার সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন বলে পররাষ্ট্র সচিবকে জানিয়েছেন। গত শুক্রবার মার্কিন অর্থ দফতরের ‘ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস’ (ওএফএসি) বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে – যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে নিষেধাজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের মধ্যে র‌্যাব এবং এর সাবেক ডিজি হিসেবে বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ ও র‌্যাবের বর্তমান ডিজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন।
নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কোনো সম্পদ থাকলে তা বাজেয়াপ্তও হতে পারে। বাংলাদেশে শুক্রবার রাত থেকে এ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তোলপাড় শুরু হলেও সরকার, পুলিশ বা র‌্যাবের দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
বেনজীর ও র‌্যাবের ডিজিসহ ৭ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা: র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পৃক্তদের সম্পদ জব্দ হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১০ ডিসেম্বর শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ রয়েছেন। তিনি এখন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। বেনজীর আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতায়ও পড়েছেন তিনি।
এ ছাড়া র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র‌্যাব-৭এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর সে দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ২০১৮ সালের মে মাসে কক্সবাজারের টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পৃক্ততার জন্য এ দুজনের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর সরকারের এক নির্বাহী আদেশের (নম্বর ১৩৮১৮) আওতায় এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ আদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্তের কথা বলা হয়েছে। রাজস্ব বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাবকে একটি বিদেশি সংস্থা হিসেবে মার্কিন সরকারের নির্বাহী আদেশের (নম্বর ১৩৮১৮) অধীনে রাখা হয়েছে। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে র‌্যাবও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে গত ১০ ডিসেম্বর রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা শুনেছি। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমাদের কিছু জানায়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে আমাদের সচিবের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে আমরা মতামত জানাব।’ ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাবের ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেনজীর আহমেদ। আর চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে র‌্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন।
মার্কিন রাজস্ব বিভাগের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা খান মোহাম্মদ আজাদ গত ১৬ মার্চ থেকে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার ২০১৯ সালের ২৭ জুন থেকে গত ১৬ মার্চ পর্যন্ত র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মো. জাহাঙ্গীর আলম ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ২৭ জুন পর্যন্ত র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) ছিলেন। আর মো. আনোয়ার লতিফ খান ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) পদে ছিলেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে র‌্যাবের বক্তব্য জানতে গতকাল রাতে কয়েক দফা এ বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এবং মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। পরে মুঠোফোনে খুদে বার্তা এবং হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একইভাবে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) কামরুজ্জামানের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। তাঁর বক্তব্যও পাওয়া যায়নি। নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। সেখানকার একজন কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সেটাই তাঁদের বক্তব্য। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিভিন্ন দেশের ১৫ ব্যক্তি এবং ১০ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চীনের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের কারণে। বিজ্ঞপ্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি ওয়ালি আডেয়েমোর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়, এ পদক্ষেপ একটি বার্তা দিচ্ছে যে যারা নিপীড়ন চালাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র কথা বলবে।
‘বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’: যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে র‌্যাবের যে কার্যক্রম, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ ও বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিকে হুমকির মুখে ফেলছে।
মার্কিন দপ্তরটি উল্লেখ করেছে, র‌্যাব ২০০৪ সালে গঠিত হয়। এর সদস্য হন পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) থেকে আসা সদস্যরা। বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বরাত দিয়ে বলা হয়, র‌্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০টির বেশি গুম, ২০১৮ সাল থেকে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। কিছু প্রতিবেদন বলছে, এসব ঘটনা বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক এবং মানবাধিকারকর্মীদের ওপরও ঘটানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের কারও নামে কিংবা কোনো মার্কিন নাগরিকের জিম্মায় কোনো সম্পদ থেকে থাকলে তা জব্দ হবে। বিষয়টি অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোলকে (ওএফএসি) অবহিত করতে হবে। ওএফএসির বিশেষ অনুমতি বা অন্য কোনো ছাড় না থাকলে মার্কিন নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য চিহ্নিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com