জীবন। জীবনের বিপরীতেই মৃত্যু। জীবন-মৃত্যুর মাঝেই রয়েছে অন্য আরেকটি জীবনের সফলতা। মাঝখানের সময়কে রণ, সংগ্রাম ও বিলাসবহুল আবেগ ত্যাগ বিসর্জন দিতে সক্ষম হলেই মিলিয়ে যাবে ‘সূরা আসর’-এর সাথে। সূরা আসরের প্রথম আয়াতের অর্থ- ‘সময়ের কসম মহাকালের কসম’ (মহাকাল বলতে দিবা-রাত্রির আবর্তন-বিবর্তনকে বোঝানো হয়েছে। রাত্রি উপনীত হলে অন্ধকার ছেয়ে যায়। আর দিন প্রকাশ পেতেই সব জিনিস উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এ ছাড়া রাত কখনো লম্বা আর দিন ছোট, আবার দিন কখনো লম্বা আর রাত ছোট হয়ে থাকে। এই দিবা-রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার নামই হলো কাল, যুগ বা সময়; যা আল্লাহর কুদরত (শক্তি) ও কারিগরি ক্ষমতা প্রমাণ করে। আর এ জন্যই তিনি কালের কসম খেয়েছেন (সূরা আসরের তাফসির থেকে নেয়া)।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ‘সময়ের কসম’ খেয়েছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সময়কে কাজে লাগাও এবং সফলতা খুঁজে বের করো তোমাদের পরবর্তী জীবনে। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝে যেই জীবনটি আছে; এই জীবনের সময়টা তুমি আরেকটি জীবনের সফলতা খুঁজো। আরেকটি জীবন বলতে মৃত্যুর পর যেই জীবন।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ সফলতা জয় করে কেউ সম্পদের বাহার দিয়ে আবার কেউ সালাত তথা নামাজ এবং সব কাজে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি দিয়ে।
সফলতা বলতে আমরা বুঝি- গরিব থেকে ধনী হওয়া, কুঁড়েঘর থেকে তালাবিহীন বড় বিল্ডিং, রিকশাওয়ালার ছেলে হয়েও বড় ব্যবসায়ী হওয়া, বাবাহীন ছেলে হয়েও কষ্ট করে পড়াশোনা করার পাশাপাশি চাকরি করা।
দুনিয়ায় প্রচলিত যত রকম কাজকর্ম আছে এসব কাজকর্মে টিকে থাকার নামই হচ্ছে বর্তমান সময়ের সফলতা।
অতঃপর এই সফলতার ভাবনায় যারা বিভোর তাদের জন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘পার্থিব দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি অনুরাগ মানুষকে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন করে ফেলে। এ কারণে পরকাল সম্পর্কে জানা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা শুধু দুনিয়ার জ্ঞানেই জ্ঞানী’ (সূরা আর-রুম, আয়াত-৭)।
প্রত্যক মুসলিম নর-নারীর সবচেয়ে বড় সফলতা ও মানদ- হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালা ভয় অর্জন করা এবং রাসূলের আদর্শে আদর্শবান হওয়া। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তারাই কৃতকার্য’ (সূরা নূর, আয়াত-৫২)।
একজন মুমিন ব্যক্তি সফলতা অর্জন করে সালাতের মাধ্যমে- কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘অবশ্যই মুমিনরা সফল হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়াবনত। আর যারা অনর্থক কথাকর্ম থেকে বিমুখ। আর যারা জাকাতের ক্ষেত্রে সক্রিয়। আর যারা তাদের নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী। তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে তারা ছাড়া, নিশ্চয় এতে তারা নিন্দিত হবে না। অতঃপর যারা এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। আর যারা নিজদের আমানতসমূহ ও অঙ্গীকারে যতœবান। আর যারা নিজেদের সালাতসমূহ হিফাজত করে। তারাই হবে ওয়ারিস। যারা ফিরদাউসের অধিকারী হবে তারা সেখানে স্থায়ী হবে’ (সূরা মুমিনুন, আয়াত : ১-১১)।
দুনিয়ার তুচ্ছতা নিয়ে হাদিসে এসেছে- জাবের রা: থেকে বর্ণিত একদা রাসূলুল্লাহ সা: একটি কান কাটা মৃত বকরির বাচ্চার কাছ দিয়ে অতিক্রমকালে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে এটাকে এক দিরহামের বিনিময়ে নিতে পছন্দ করবে? তারা বললেন, আমরা তো এটাকে কোনো কিছুর বিনিময়েই নিতে পছন্দ করব না। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটা তোমাদের কাছে যতটুকু নিকৃষ্ট, আল্লাহর কাছে দুনিয়া (এবং তার সম্পদ) এর চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট’ (মুসলিম, মিশকাত হাদিস-৫১৫৭)। অর্থাৎ যেই ব্যক্তি দুনিয়া এবং তার সম্পদ নিয়ে থাকে, তাকে মহান আল্লাহ তায়ালাও ভালোবাসেন না।
দুনিয়ার জীবন খুবই মায়াবিনী এবং অল্প সময়ের ক্ষণস্থায়ী একটা পথ। এই পথ পাড়ি দিয়েই যেতে হবে চিরস্থায়ী জীবনে।কেউ জাহান্নামে, কেউ সাজসজ্জাহীন সুন্দর জান্নাতে এবং এই মায়াবিনী দুনিয়াতে সফলতা জয় না করে যদি মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালাকে ভালোবাসায় নিজেকে জয় করেন তাহলে এটাই হবে একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় সফলতা।
আপনি দুনিয়াতে বেঁচে থাকা অবস্থায় দুনিয়ার সব কিছুতে সফলতা অর্জন করেছেন এবং সফলতা অর্জন করতেই পারেন। আপনার এই দুনিয়াবি সফলতায় আপনাকে ছোট করছি না। কারণ দুনিয়াটা চলেই হক-বাতিল দিয়ে। অতএব, হক-বাতিল যেমন দুনিয়াতে থাকবে, তদ্রুপ ধনী-গরিবও দুনিয়াতে থাকবে।
হক-বাতিল ছাড়া যেমন দুনিয়া চলে না ঠিক তেমনিভাবে ধনী-গরিব ছাড়াও দুনিয়া চলবে না। এটা চিরসত্য এবং বাস্তবতা। অতঃপর, প্রতিটি মানুষের ভেতর সময় নষ্ট না করার চেতনা জাগ্রত থাকা। সময়কে কাজে লাগিয়ে নিজের জীবনকে পরিচালনা করা। আর এভাবে চললে হয়তো মিলেও যেতে পারে সূরা আসরের সাথে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।