দেশের শিল্প-কারখানার কর্মপরিবেশ ও অবকাঠামো মূল্যায়নে কাজ করছেন বিশেষজ্ঞরা। গঠন করা হয়েছে ১০৮টি দল। সরকার গঠিত এসব দলের সদস্য সংখ্যা এক হাজারের বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পাঁচ হাজার কারখানা পরিদর্শনের লক্ষ্য তাদের। এরই মধ্যে ১ হাজার ৬০০ কারখানা পরিদর্শন শেষ হয়েছে। এতে ধরা পড়েছে বেশকিছু অসঙ্গতি। তালিকায় রয়েছে অনেক বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এই কর্মযজ্ঞ শেষ হবে ফেব্রুয়ারির মধ্যে। পরিদর্শন শেষে প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে চলতি মাসেই করণীয় ঠিক করতে সুপারিশমালা প্রণয়ন করবেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর শিল্পখাতে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে গত বছর নারায়ণগঞ্জে। ২০২১ সালের ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ে প্রাণ হারান ৫২ শ্রমিক। তখনই সারাদেশের শিল্প-কারখানার প্রকৃত অবকাঠামো বের করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডার) নেতৃত্বে শিল্প-কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে প্রধান করে ২৪ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কারখানায় প্রকৃত কর্মপরিবেশ আছে কি না, অবকাঠামো ঠিক আছে কি না, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে কি না, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না- এসব বিষয় পরিদর্শন করতে ১০৮টি দল গঠন করা হয়। প্রতিটি দলে ১০ জন করে মোট ১ হাজার ৮০ জনকে বাছাই করে তাদের একদিনের প্রশিক্ষণ দেয় বিডা।
২৪ সদস্যের কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় এলাকার সংসদ সদস্য, সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন/পৌরসভার মেয়র, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবকে। এছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব, বাণিজ্য সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব, শিল্প সচিব, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন), গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, এফবিসিসিআই সভাপতি ও বিজিএমইএর সভাপতিও আছেন কমিটিতে।
বিডার জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার ম-ল জাগো নিউজকে বলেন, পাঁচ হাজার কলকারখানা ভিজিট করা হবে। এখনো পরিদর্শন চলছে। এই পরিদর্শনের মাধ্যমে কোনো কলকারখানা বন্ধ হবে না। কর্মপরিবেশ আছে কি না বা কী নেই, এগুলোর একটা চেকলিস্ট করা হবে।
সব প্রশিক্ষণ শেষ, নারায়ণগঞ্জ থেকে পরিদর্শন শুরু: বিডা বলছে, সারাদেশে ৩২ খাতের প্রায় ৪৫ হাজার কারখানা আছে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার কারখানা পরিদর্শন করা হবে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যেসব খাতের কারখানায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো পরিদর্শন করা হবে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স ও কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের অডিটে থাকায় তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী শিল্পকে পরিদর্শন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
পরিদর্শনের সবশেষ অবস্থা সম্পর্কে বিডার নির্বাহী সদস্য এবং কারখানা পরিদর্শনে সরকার গঠিত কমিটির আহ্বায়ক অভিজিৎ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমরা গত ডিসেম্বরের ১১ তারিখ পরিদর্শন শুরু করেছি। নারায়ণগঞ্জ দিয়ে আমাদের পরিদর্শন শুরু হয়েছে। ট্রেনিং প্রোগ্রামগুলো শেষ। সবশেষ ট্রেনিং করেছি ৯ জানুয়ারি। এর মধ্যে আমাদের কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশনা ছিল যে, প্রথম মাসে পাঁচ হাজার পরিদর্শন শেষ করবো। সেই পরিদর্শনের আওতায় সবশেষ প্রায় ১ হাজার ৬০০ কারখানা আমরা পরিদর্শন করেছি। পরিদর্শন শুরুর পর কিছু রিপোর্ট ম্যানুয়ালি আসছিল। তখন আমরা সফটওয়্যার ডেভেলপ করার পর এখন তা ইনপুট দেওয়া হচ্ছে। গত ১৯ জানুয়ারি একটা মিটিং করেছি সব অফিসপ্রধানদের নিয়ে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে বিষয়টা রিভিউ করেছি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এ পর্যন্ত যতটুকু পরিদর্শন হয়েছে সেখান থেকে আমরা আপাতত সেক্টর অনুযায়ী কিছু ফাইন্ডিংস বের করবো।
তিনি বলেন, প্রতিটি সেক্টরের দু-একটা ফ্যাক্টরি আমরা কাভার করার চেষ্টা করছি। পরিদর্শন শেষে আমরা তিনভাবে সুপারিশগুলো আনবো। একটা হলো- ওভারঅল রিকমেন্ডেশন, সেক্টরওয়াইজ ও এলিমেন্ট রিকমেন্ডেশন। ধরেন, অগ্নিনির্বাপণের সিঁড়ি নেই অধিকাংশ কারখানায়, ইলেকট্রিক লাইনগুলো ঠিকমতো বসানো হয়নি। এমন এলিমেন্টওয়াইজ সুপারিশগুলো রেডি করছি। এরপর এটি এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল মিটিংয়ে আলোচনা করে জাতীয় কমিটিতে দেবো। জাতীয় কমিটি সেগুলো দেখবে। আমরা আশা করছি, ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমাদের তিনটি গ্রুপের ১০৮ জন পাঁচ হাজার কারখানা পরিদর্শন করতে পারবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ও কলকারখানা পরিদর্শন কমিটির সদস্য ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, যেসব ফ্যাক্টরি অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সে বা কলকারখানা অধিদপ্তরের আগের অডিটে আছে সেগুলো ভিজিট করা হচ্ছে না। কারণ সেগুলো তো কোনো না কোনোভাবে একটা ভিজিটের মধ্যে আছে। এ কারণে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে ভিজিট নেই বললেই চলে। নতুন যেসব ফ্যাক্টরি লাইসেন্স নিয়েছে সেগুলো তো ভিজিট হচ্ছে। আমার জানা মতে, গার্মেন্টসগুলো ভিজিট করা হচ্ছে না। কেননা গার্মেন্টসগুলো অলরেডি ভিজিটেড। কিন্তু অন্যান্য কারখানা ভিজিট করা হচ্ছে।
কলকারখানা পরিদর্শনে মিলছে নানা ধরনের ত্রুটি: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কারখানায় গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার দেখা মেলেনি। অধিকাংশ কারখানার নকশায় ত্রুটি রয়েছে, নেই অনুমোদন। অনেক কারখানারই সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ছাড়পত্র নেই, অনেকগুলোরই ট্রেড লাইসেন্সও পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিদর্শন কমিটির এক সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এখন যেটা পাচ্ছি কারখানাগুলোতে সেটা খুব সুখকর কিছু নয়। ভয়াবহ বলা চলে। কোনো স্কুলে যখন প্রথম ছাত্র, দ্বিতীয় ছাত্রের দিকে বেশি নজর রাখা হয় তখন বাকিরা ফেল করে। রপ্তানিমুখী শিল্পে নজরদারি থাকলেও অন্য খাতে নজরদারি অবহেলিত থেকে গেছে।
বেশ কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক বড় ফ্যাক্টরি দেখেছি অথচ বেসিক সেফটি মেজর নেই। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। যদি শর্টসার্কিট হয় তাহলে বড় দুর্ঘটনা ঘটবে।
ফজলে শামীম এহসান বলেন, অনেক ফ্যাক্টরিতে কমপ্লায়েন্সের কালচার গড়ে ওঠেনি। গার্মেন্ট সেক্টরে সবার নজর ছিল। এ সেক্টর কমপ্লায়েন্সের চরম সীমানায় ছিল। ফলে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সেক্টরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়েছেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু অন্য কারখানায় কোনো নজরদারি ছিল না।
কারখানা পরিদর্শন করে কী কী পাওয়া যাচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, প্রথমে আমরা একটা চেকলিস্ট তৈরি করেছিলাম প্রায় ১০০ প্রশ্ন সংকলিত। সেখানে নয়টি বিভাগের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। অবকাঠামো দেখা হচ্ছে, ইলেক্ট্রিসিটি দেখছি, গ্যাস দেখছি, বয়লার দেখছি, বিস্ফোরক পদার্থসহ পরিবেশ দেখছি। এ বিষয়গুলোতে ওই ফ্যাক্টরিতে কতটা কমপ্লায়েন্স করা আছে, কতটা নেই সেগুলো ১০০ প্রশ্নের মাধ্যমে উঠিয়ে নিয়ে আসছি। ওখানে গ্রেডিং করা হচ্ছে।
করোনায় হতে পারে বিলম্ব: অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, এখন যে রিপোর্ট মাঠ পর্যায় থেকে আসছে তাতে আমার কোনো কোনো টিমের সদস্য কোভিড আক্রান্ত হচ্ছেন। কিশোরগঞ্জ থেকে খবর এসেছে, একজন টিম লিডার জানান ওনার টিমের পাঁচজন কোভিড আক্রান্ত। আরও অনেক জায়গা থেকে এমন খবর আসছে। এ অবস্থায় আমরা কী করবো সেটা ভাবার বিষয়।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক সম্মেলনে এ বিষয়ে ব্রিফ করা হয়েছে। আমরা সবাই চেষ্টা করছি। এখন করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়লে কতটা কী হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
জানা যায়, প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কারখানা আছে, যারা খাদ্য উৎপাদন করে। তিন হাজার ৩২৬টি কারখানা আছে বস্ত্রখাতে। প্রকৌশলখাতে আছে দুই হাজার ৭০৪টি কারখানা। এসবের মধ্যে ৬৪৫টি গ্রিন ফ্যাক্টরি বা পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে চিহ্নিত। এসব কারখানাকে নিরাপদ কারখানাও বলা হয়। অন্য কারখানার পাশাপাশি এসব গ্রিন ফ্যাক্টরিও পরিদর্শন করবে বিডার পরিদর্শন দল। অনিরাপদ কারখানা কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে তার ধারণা এসব গ্রিন ফ্যাক্টরি থেকে সংগ্রহ করা হবে।-জাগোনিউজ২৪.কম