নারী সদস্যদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) প্রণয়ন করেছে ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন বন্ধে নীতিমালা ও কর্মপন্থা ২০২১’।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার আলোকে পুলিশ সদর দফতরের গাইডলাইনস অনুসরণ করে ডিএমপির সব বিভাগে নারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে এই নীতিমালা ও কর্মপন্থা প্রণীত হয়। ডিএমপির কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের নির্দেশনায়, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) মীর রেজাউল আলমের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হামিদা পারভীনের পরিকল্পনায় ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন বন্ধে নীতিমালা ও কর্মপন্থা ২০২১’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর প্রকাশনায় কাজ করেছে ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। এ সম্পর্কে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা মহানগর এলাকার সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের প্রতি সংবেদনশীলতা ও তাদের অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নারী ও শিশুর প্রতি সব প্রকার সহিংসতা প্রতিরোধে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ডিএমপি। পুলিশের সর্ববৃহৎ এই ইউনিটে বর্তমানে দুই হাজারের অধিক নারী সদস্য কর্মরত। জেন্ডার সংবেদনশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের জন্য নিরাপদ ও অধিকতর সহনশীল কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বদ্ধপরিকর।’
‘সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশন ৫৯১৬/২০০৮-এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার আলোকে পুলিশ সদর দফতরের গাইডলাইনস অনুসরণ করে এ নীতিমালা ও কর্মপন্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিএমপিতে কর্মরত সকল নারী সদস্যের হয়রানিমুক্ত নিরাপদ কর্মপরিবেশে তাদের ওপর অর্পিত দায?িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস’, যোগ করেন ডিএমপি কমিশনার।
হাইকোর্টের নির্দেশনায় নীতিমালা ও কর্মপন্থা প্রণয়ন: কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই যা রক্ষাকবচ হিসেবে সংবিধানে উল্লিখিত জেন্ডার সমতাকে নিশ্চিত করতে পারে। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে নারীর প্রতি যৌন হয়রানিমূলক ঘটনা। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন ল’ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনডব্লিউএলএ) ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থমূলক রিট পিটিশন নং-৫৯১৬/২০০৮ দায়ের করে। দায়েরকৃত রিট পিটিশনের রায়ে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১১টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন।
উল্লিখিত নির্দেশনার আলোকে ‘ডাইরেক্টিভস ইন দ্য ফরম অব গাইডলাইনস’-এর পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের ১১১নং অনুচ্ছেদের মর্মার্থ অনুযায়ী যতদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে উপর্যুক্ত আইন প্রণয়ন না হবে ততদিন পর্যন্ত সকল সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে এ গাইডলাইনস অনুসরণ ও পালন বাধ্যতামূলক।
ওই নির্দেশনার আলোকে ডিএমপির সকল ইউনিটে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ ও যৌন নির্যাতন বন্ধে একটি কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন পদে দুই হাজারের অধিক নারী সদস্য রয়েছেন এবং কর্মরত নারী ও পুরুষের অনুপাত প্রায় ১:১০। পুলিশ সদর দপ্তরের গাইডলাইনের আলোকে ডিএমপির সকল বিভাগে কর্মরত পুলিশ সদস্য, নন পুলিশ, সিভিল স্টাফ অথবা প্রেষণে কিংবা চুক্তিভিত্তিক বা অন্য কোনোভাবে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে অভিযোগ গ্রহণ, অনুসন্ধান সম্পাদন ও সুপারিশ প্রদানসহ যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধকল্প এই নীতিমালায় প্রণীত হয়েছে।
নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: এই নীতিমালা ও কর্মপন্থা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাভুক্ত বিভাগসমূহের সকল পর্যায়ে কর্মরত নারী সদস্যদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি হতে সুরক্ষা প্রদান। যৌন হয়রানি সম্পর্কে ডিএমপিতে কর্মরত সকল পুলিশ সদস্যের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলা। যৌন হয়রানিমূলক আচরণ থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত সকল সদস্যকে বিরত রাখা।
অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটি: হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে একটি অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটি গঠন করতে হবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জন্য কমিটির গঠনতন্ত্র হবে নি¤œরূপ: (ক) কেন্দ্রীয় অভিযোগ গ্রহণ কমিটি : অভিযোগ গ্রহণ, অনুসন্ধান পরিচালনা ও সুপারিশের জন্য জেন্ডার ব্যালেন্সের ভিত্তিতে ডিএমপির ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘কেন্দ্রীয় অভিযোগ গ্রহণ কমিটি’ গঠন করা হবে।
কমিটিতে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) সভাপতি, উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার সদস্য সচিব, সদর দফতর ও প্রশাসনের উপ-পুলিশ কমিশনার সদস্য, মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের বিভাগীয় মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সদস্য এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও জেন্ডার বিষয়ক এনজিওর একজন প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে থাকবেন।
বিভাগীয় অভিযোগ গ্রহণ কমিটি: কেন্দ্রীয় অভিযোগ গ্রহণ কমিটি ব্যতীত ডিএমপির আওতাধীন ৫৭টি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জেন্ডার ব্যালেন্সের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র ‘বিভাগীয় অভিযোগ গ্রহণ কমিটি’ গঠন করবে।
অ্যাড হক কমিটি: অভিযোগ গ্রহণ কমিটির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করা হলে তা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ প্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযুক্ত সদস্যকে বাদ দিয়ে নতুন সদস্য করে একটি অ্যাড হক কমিটি (অন্তর্র্বতীকালীন কমিটি) গঠন করবেন। কমিটির সভাপতি হবেন অভিযুক্ত ব্যক্তি অপেক্ষা ঊর্ধ্বতন পদে আসীন কোনো ব্যক্তি।