দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের শ্রমে যা অর্জিত হয়। এই প্রবাসীদের সেবাপ্রাপ্তি সহজ করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। বিশেষ করে সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অপরিহার্য দলিল বলে বিবেচিত জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সহজে মেলে না প্রবাসীদের। এ কারণে রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের মধ্যে এক কোটিরও বেশি ‘পরিচয়হীন’। ফলে বিদেশ থেকে ফিরে কোথাও পরিচয়পত্র দেখাতে না পারলে তাদের পড়তে হয় নানা সমস্যায়। এসব প্রবাসীকে পরিচয়পত্র দিতে একটি প্রকল্প রয়েছে সরকারের। যেখানে বরাদ্দও আছে শত কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প গ্রহণের এক বছরের বেশি সময় পেরোলেও ফল এখনো শূন্য।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগ সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রবাসীদের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রবাসেই তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না পাওয়ায় কাজটি শুরু করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন প্রবাসীসহ সংশ্লিষ্টরা। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পটির কাজে এ অচলাবস্থার জন্য করোনা পরিস্থিতিকে দায়ী করছেন। মালয়েশিয়ায় এনআইডির কার্যক্রম উদ্বোধন হওয়ায় বেশ খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি আমার যে মোবাইল নম্বর, সেটা দিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কার্যক্রমই শুরু করা যাচ্ছে না। একই অবস্থা আমার পরিচিত কয়েকজন প্রবাসীরও। ফলে আদৌ এনআইডি পাবো কি না সেটি নিয়ে সংশয়ে আছি
এনআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বের ৪০টি দেশে মোট এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ বাংলাদেশি রয়েছেন এনআইডি ছাড়া। তাদের এনআইডি দেওয়ার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন নিয়ে সেসব দেশে যেতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। অনলাইনে আবেদন করলেও প্রবাসীদের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর সেটি ঠিক থাকলে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট ও চোখের আইরিশ নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এই কার্যক্রমের জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর মেয়াদে ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিয়া) দ্বিতীয় পর্যায়’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রকল্পের আওতায় প্রবাসে নিবন্ধন টিম পাঠানো ও বাংলাদেশি নাগরিকদের নিবন্ধন সংক্রান্ত ব্যয় হিসাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না থাকায় কাজ শুরু করা যায়নি, সেই টাকাও হচ্ছে না ব্যয়।
যদিও ২০২০ সালের শুরুর দিকে করোনার প্রাদুর্ভাবকে এ কার্যক্রম শুরুর ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, কিন্তু মাঝে কিছুটা সময় পরিস্থিতি সামলে ওঠা গেলেও কাজ আর শুরু হয়নি।
জানা যায়, ২০১৭ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে মুক্ত আলোচনায় প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে তাদের এনআইডির বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, ‘দেশের প্রায় ৯০ লাখ নাগরিক (বর্তমানে এক কোটি ৪০ লাখের বেশি) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন এবং দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। বিভিন্ন কারণে তাদের অনেকে এনআইডি প্রস্তুত করতে পারেননি। এনআইডি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উপস্থিতি আবশ্যক। এটি প্রাপ্তি বা সংশোধনের জন্য প্রবাসীদের বাংলাদেশে আসতে হয়। ফলে তারা ভোগান্তির সম্মুখীন হন। তাই বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান, সশোধন ও স্মার্টকার্ড দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।’ সেসময় প্রস্তাবটি পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন দেন। পরে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসীদের এনআইডি দেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের এনআইডি প্রদান ও ভোটাধিকার সংক্রান্ত একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেখানে রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা তাদের মতামত দেন। পরে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ংবৎারপবং.হরফ.িমড়া.নফ ওয়েবসাইট উদ্বোধনের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এ কার্যক্রম উদ্বোধন হয়। তৃতীয় দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে প্রবাসীদের এনআইডি দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। প্রবাসী ভোটারদের বিষয়গুলো ইলেকশন কমিশনের দায়িত্ব। তারা এর মধ্যে আর কোথাও যেতেও পারেনি, এই প্রোগ্রামটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আমাদের কাছে কোনো চিঠি তারা (ইসি) দেয়নি। আন্দাজে বলে কেন? তারা কী দিয়েছে? কার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে, আমি জানি না, আমি দেখিনি
এনআইডি চেয়ে প্রবাস থেকে ২৫৫৩ আবেদন: কর্মকর্তারা জানান, প্রবাসীদের পরিচয় নিবন্ধনের জন্য চালু করা পোর্টালে এ পর্যন্ত দুই হাজার ৫৫৩টি আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে ২৩৯টি, সৌদি আরব থেকে ৯১২টি, সিঙ্গাপুর থেকে ১৫১টি, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৭৪১টি ও যুক্তরাজ্য থেকে ৪৮৫টি, মালদ্বীপ থেকে ছিল ২৫টি। যাচাই-বাছাই করে ৭০০ জনের কাগজপত্র ঠিক থাকায় তাদের আবেদনের অনুমোদন মিলেছে। যদিও অনেক প্রবাসী অভিযোগ করেছেন, এই পোর্টালে তারা ঢুকতেই পারছেন না, আবার কেউ কেউ আবেদনটিই সম্পন্ন করতে পারছেন না।
রাসেল হৃদয় দীর্ঘ সাত বছরের বেশি সময় ধরে মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি দেশত্যাগের আগে এনআইডি করেননি। এখন বয়স ২৯ বছর পেরুলেও পরিচয়হীন তিনি। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন রাসেল। সেজন্য মালয়েশিয়ায় এনআইডি কার্যক্রম উদ্বোধনের পর বেশ খুশি হয়েছিলেন এই রেমিট্যান্সযোদ্ধা। তবে সেই আনন্দ বেশিদিন থাকেনি, তার মালয়েশিয়ান মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধনের চেষ্টা করলেও সেটি কোনোভাবেই নেয়নি এই ওয়েবসাইট।
রাসেল হৃদয়বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায়। যখন এখানে এসেছি তখন আমার এনআইডি হয়নি। পরে দেশে যাওয়া হয়নি আর এনআইডি কার্ডও করা হয়নি। মালয়েশিয়ায় এনআইডির কার্যক্রম উদ্বোধন হওয়ায় বেশ খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি আমার যে মোবাইল নম্বর, সেটা দিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কার্যক্রমই শুরু করা যাচ্ছে না। একই অবস্থা আমার পরিচিত কয়েকজন প্রবাসীরও। ফলে আদৌ এনআইডি পাবো কি না সেটি নিয়ে সংশয়ে আছি।’
আমাদের দেশে জন্মের পরপরই প্রত্যেক নাগরিককে একটি নম্বরের আওতায় আনা যায় কি না, যেই নম্বর ভবিষ্যতে তার জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক কার্ড হবে। সারাবিশ্বেই এই সংস্কৃতি আছে, প্রত্যেকের একটা নম্বর থাকে। আমি মনে করি সেই জিনিসগুলো মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশন যদি একটি প্রকল্প নিয়ে থাকে, সবাইকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়, এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ হবে
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ মালয়েশিয়ায় কার্যক্রমটির উদ্বোধন করলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলেও মন্ত্রী কথা বলতে রাজি হননি। পরে তার সহকারী একান্ত সচিব মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘এটি দেখভাল করবে নির্বাচন কমিশন, কাজটি তাদের। কার্যক্রমটি যখন উদ্বোধন করা হয় তখন মন্ত্রী মহোদয় মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছিলেন, সেখানকার হাইকমিশনারের অনুরোধে তিনি অনুষ্ঠানে গেছেন।’ এ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারবলেন, ‘যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ কিছু দেশে যেহেতু আমাদের অনেক নাগরিক আছেন, সেখানে গিয়ে তাদের ভোটার তালিকায় এনে এনআইডি কার্ড করে দেওয়ার কথা আমাদের। বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। এটা যখনই ওনাদের সঙ্গে আমাদের ম্যাচ করে যাবে (মিলবে), ক্লিয়ারেন্স (অনুমোদন) পেয়ে যাবো, তখনই কাজটি হবে। বরাদ্দও আছে, আমাদের টিমও রেডি আছে, বিদেশে গিয়ে এনআইডির বিষয়ে কাজ করবে তারা।’ বিদেশে এনআইডি দেওয়ার কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলামবলেন, ‘এটা স্থগিতও নয়, আবার চলমানও নয়। আমরা আবার শুরু করবো, কোভিড পরিস্থিতিতে এটি নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়নি। কোভিড পরিস্থিতি যখন পরিবর্তিত হবে, যখনই আমাদের লোকজন গিয়ে ওখানে কাজ করার অনুমতি পাবে, তখন হয়তো পরবর্তী কমিশন এসে এগুলো চিন্তাভাবনা করবে। প্রবাসী যারা অনলাইনে আবেদন করছেন, তাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে গেলে আমাদের একটা টিমকে পাঠাতে হবে সেই দেশগুলোতে। অনলাইনে আবেদনের ওপর ভিত্তি করে যদি দেখা যায় যে, একটা টিম পাঠিয়ে এটা করা যাবে, তখনই কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনলাইনে টিম পাঠানোর মতো সাড়া পাওয়া যায়নি। আবার যেসব জায়গা থেকে অনলাইনে আবেদন পাওয়া গেছে সেসব জায়গায় টিম পাঠিয়ে এই কার্যক্রম শুরুর জন্য অনুমোদনের যে প্রক্রিয়া আছে, সেটা কোভিডের জন্য স্থগিত হয়ে আছে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘প্রবাসীদের এনআইডি নিবন্ধনের কাজটি শুরুর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ডিজিটাল পদ্ধতিতে করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা হয়েছিল। অনেকদূর অগ্রসরও হয়েছিলাম, করোনার কারণে পারিনি। আমরা লন্ডন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, আবুধাবি, সৌদি আরবে শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি। এটা জটিল কাজ, কিন্তু সম্ভব। আমাদের প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে থাকেন। যখন বিদেশে যাই, তারা তখন আমাদের কাছে আসেন, বলেন যে তারা ভোট দিতে পারেন না। তাদের তো জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, গ্রামে গিয়ে তাদের সম্পত্তি হস্তান্তরসহ সব ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে। সেজন্যই এ উদ্যোগ নিয়েছিলাম।’
পাঁচ বছরে ৪০ দেশে প্রবাসীদের এনআইডি দেওয়ার চিন্তা: সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রবাসীদের সুবিধা বিবেচনায় প্রবাসেই এনআইডি দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নেয়, সে পরিকল্পনায় প্রতি বছর আটটি করে পাঁচ বছরে ৪০টি দেশের প্রবাসীদের এনআইডি সেবা দেওয়ার চিন্তা আছে। যদিও অর্থ বরাদ্দের এক বছর পেরোলেও কাজে কোনো অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে এনআইডি উইংয়ের সাবেক মহাপরিচালক (বর্তমানে সেনা কল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামবলেন, ‘আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিক বাইরে থাকেন। তারা এনআইডি পান না, কারণ তারা দেশে আসতে পারেন না অথবা দেশে এলেও অল্প সময়ের ছুটিতে আসেন, সেই সময়ের মধ্যেই তাদের এনআইডি করা এবং অন্য কাজগুলো করা কঠিন হয়। এতে তাদের জমি রেজিস্ট্রেশনসহ অন্য কাজগুলো অল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব হয় না। সেজন্য আমাদের চিন্তা ছিল এনআইডি সেবাটা তাদের হাতের মুঠোয় কীভাবে পৌঁছানো যায়, সে ব্যবস্থা করা। এজন্য নেওয়া হয় উদ্যোগ। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ৪০টি দেশে কার্যক্রম শুরুর জন্য অনুমোদন হয়। এখন গ্রাজুয়ালি অনলাইন-অফলাইন দুটোর মাধ্যমেই যেন এই সেবাটা দিতে পারি সে চেষ্টা চলছে। এর মাধ্যমে আপনি যেখানেই থাকেন, দেশের জন্য কন্ট্রিবিউশনে যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন সেটি আমরা করবো।’ সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মালয়েশিয়া, আবুধাবি, লন্ডনÍএই তিন জায়গায় অনলাইন পোর্টাল উদ্বোধন করেছিলাম, আবেদন নেওয়া শুরু করেছিলাম। আমাদের টার্গেট ছিল পর্যায়ক্রমে আমরা এটা পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবো। সে অনুসারেরা প্রকল্পও নিয়েছিলাম এবং সেখানে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। সেটার মাধ্যমে এই ৪০টি দেশে থাকা প্রবাসীদের এনআইডি সেবা দিতে পারবো।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না পাওয়ায় জটিলতা:প্রবাসীদের এনআইডি দিতে সব প্রস্তুতি থাকলেও কাজটি শুরু করতে না পারার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায় দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কার্যকর কোনো সমাধান মেলেনি।
এ বিষয়ে আইডিয়া প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদেরবলেন, ‘আমরা পরিকল্পনা করেছি এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি বছর আটটি দেশে যাবো। মোট যাবো ৪০টি দেশে। একটি জায়গায় টানাপোড়েন চলছে, দেখা যাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে ডিজি বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেবেন, তিনি আমাদের কাজটি সম্পন্ন করতে করতেই বদলি হয়ে গেছেন। গত ১৩ অক্টোবর ও ১৭ নভেম্বরও আমরা চিঠি দিয়েছি, সেসময় এনআইডি উইংয়ের ডিজিও গিয়েছিলেন যেসব দেশ থেকে আবেদন আসছে সেসব দেশে যাওয়ার বিষয়ে। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে আপনারা (এনআইডি উইং) যাবেন কেন, আমাদের (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) মেশিন দিয়ে দেন আমরাই করি, কিন্তু সেটা তো হয় না। সেটি করতে গেলে তো রোহিঙ্গাসহ বাইরের দেশের অনেকেই যুক্ত হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের যে স্ট্যান্ডার্ড আছে, সেটি হবে না। আমরা চিঠি দিয়েছি, তারা (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) আমাদের চিঠির উত্তর দিচ্ছে না। আমাদের চিঠি দিয়ে হচ্ছে না, হয়তো সশরীরে গিয়ে এটি করাতে হবে। আমরা যাওয়ার জন্য রেডি।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারণেই এ কার্যক্রমে জটিলতা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনই তো মিলছে না। আমরা লন্ডনের সঙ্গে কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছি। সেখানে কোথায় কোথায় যাওয়া হবে, তাদের সঙ্গে মিটিংও হয়েছে। চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি মিলছে না। একটা টিম গেলে মেশিন নিয়ে যাবে, কারণ তাদের অনুমতি না পেলে এই মেশিন দেশে ফেরত আনতে আবার ট্যাক্স দিতে হবে। কয়েকবার লন্ডন থেকে আমাদের তাগাদা দিয়ে চিঠি দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের দুই হাজার ৫৫৩টি আবেদন পড়েছে, সেখান থেকে আমরা ৭০০ আবেদনের সমাধান করেছি। বাকিগুলোর নথিপত্র ঠিক নেই। কিছু ভুয়া আছে বলে মনে হয়েছে, সেগুলোকে আমরা দেইনি।’
তিনি বলেন, ‘প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছি। এই ৪০টি দেশে সর্বমোট এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ জন এনআইডি ছাড়া রয়েছেন। তারা বাংলাদেশি, কিন্তু বিদেশে এনআইডি ছাড়া বসবাস করছেন। এটি বাড়বে-কমবে। আমাদের সঙ্গে লন্ডন, কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যোগাযোগ করছে। বলেছি আমাদের পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও একটি চিঠি দিন। কারণ তাদের অনুমতি ছাড়া তো আমরা কোথাও যেতে পারবো না। যাওয়ার অনুমোদন হলে ৪০টি দেশের জন্য একটি পোর্টাল ওপেন করে দেবো এবং একটি সার্কুলার দেবো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত রাখিনি। করোনার কারণে মালয়েশিয়ার ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছি না। ওয়েবসাইটে তো যে কেউ অ্যাপ্লিকেশন করতে পারেন। অ্যাপ্লিকেশন করলে আমরা তদন্ত করে দেখি। কিন্তু তাকে তো ফিঙ্গার প্রিন্ট, আইরিশ দিতে হবে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘দুই বছর ধরে সারা দুনিয়াতে কোভিড-১৯। সেজন্য এগুলো সব স্থগিত। কোভিড-১৯ যদি দূর হয়, তারা যদি ভিসা দেয় তাহলে আমাদের লোকজন যাবে। বিদেশে আমাদের মিশনগুলোতে এসে তথ্য দিয়ে যায়, তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট, আইরিশ দিয়ে যায়। কোভিডের ফলে এখন লোক আসতে পারে না, খুব সিলেক্টেড লোক আসে। শুধু দেশে ফেরার ভিসার জন্য আসে। অন্য সব ধরনের কাজকর্ম স্থগিত। সেখানে লাইন ধরতে দেয় না। ব্রিটিশ, স্প্যানিশ, আমেরিকানরা কোনো মিশনে লাইন ধরতে দেয় না, দাঁড়াতে দেয় না। তারা নির্ধারণ করে দিয়েছে কতজন লাইনে থাকবে।’
নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমতি চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও অনুমতি মিলছে নাÍএমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রবাসী ভোটারদের বিষয়গুলো ইলেকশন কমিশনের দায়িত্ব। তারা এর মধ্যে আর কোথাও যেতেও পারেনি, এই প্রোগ্রামটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের কাছে কোনো চিঠি তারা (ইসি) দেয়নি। আন্দাজে বলে কেন? তারা কী দিয়েছে? কার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে, আমি জানি না, দেখিনি।’
জানতে চাইলে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার আশিকুন নবী চৌধুরী বলেন, ‘করোনার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার লন্ডন হাইকমিশনে এসেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, এখানে শিগগির এনআইডির কার্যক্রম চালু করা হবে। কিন্তু করোনার কারণে সেটি চালু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে লন্ডন হাইকমিশন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে, যেন পরিস্থিতির উন্নতি হলে শিগগির লন্ডনসহ অন্যান্য শহরে এনআইডির ব্যবস্থা করা যায়।’
যেসব দেশে প্রবাসীদের এনআইডির কার্যক্রম: প্রবাসীদের এনআইডি দিতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, মিশর, ব্রুনাই, মরিশাস, ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক ও সাইপ্রাসে কার্যক্রম চালাবে নির্বাচন কমিশন।
২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশন থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে জানানো হয়, মালয়েশিয়ায় ৮ থেকে ৯ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করেন, যার মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ প্রবাসীর এনআইডি নেই। কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, সেখানে বসবাসরত চার লাখ বাংলাদেশির মধ্যে ৫০ হাজার প্রবাসীর এনআইডি নেই। মিশরের বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, সেখানে বসবাসরত আট হাজার প্রবাসীর মধ্যে পাঁচ হাজারের এনআইডি নেই। এছাড়া আইডিয়া প্রকল্পের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবে চার লাখ ৪৯ হাজার ৫৮৮ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪১ হাজার ৫৫২, যুক্তরাজ্যে ১০ হাজার ১০৭, ইতালিতে ৫৫ হাজার ৫২০, হংকংয়ে পাঁচ হাজার, মিশরে ২৩ হাজার ৮৪, ব্রুনাইয়ে ৭৪ হাজার ৮৯৩, মরিশাসে ৬৯ হাজার ৪৭৬, ইরাকে ৭৫ হাজার ৭৪৮, যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ হাজার, জাপানে ৬০ হাজার, অস্ট্রেলিয়ায় ৪০ হাজার, গ্রিসে ২৫ হাজার, স্পেনে ৮০ হাজার, জার্মানিতে ২০ হাজার, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১০ হাজার, ফ্রান্সে ১২ হাজার, নেদারল্যান্ডসে ৭ হাজার, বেলজিয়ামে ছয় হাজার, সুইজারল্যান্ডে পাঁচ হাজার, ব্রাজিলে ২৫ হাজার, চীনে ১৫ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ২০ হাজার, নিউজিল্যান্ডে আড়াই হাজার, রাশিয়ায় ছয় হাজার, তুরস্কে পাঁচ হাজার, সাইপ্রাসে সাত হাজার প্রবাসীসহ মোট ৪০টি দেশে এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ প্রবাসী এনআইডি পাননি।
জন্মের পরপরই প্রত্যেক নাগরিককে একটি নম্বরের আওতায় আনার পরামর্শ:দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের সেবাপ্রাপ্তিতে এনআইডি দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘প্রবাসীদের ভোটার করার সংস্কৃতি বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আছে। তারা দেশে থাকুন বা দেশের বাইরে থাকুন, তারা তো আমাদের দেশের নাগরিক। সমস্যাটা হলো প্রবাসী যারা আছেন, তারা তো সেই স্বাধীনতার পর থেকে যাচ্ছেন (প্রবাসে), এনআইডির কাজটি শুরু হয়েছে ২০০৭ বা ২০০৮ সালে। এরপর অনেকেরই এনআইডি নেই। এটি পাওয়া সবার অধিকার। আমাদের যে এক কোটি প্রবাসী আছেন, তাদের এনআইডি দেওয়াটা দায়িত্ব মনে করি। কারণ এনআইডি না থাকার কারণে তারা নানান ধরনের সংকটে পড়েন। পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধনসহ নানা ক্ষেত্রে তারা দুর্ভোগে পড়েন।’
পরামর্শ দিয়ে শরিফুল হাসান বলেন, ‘আমাদের দেশে জন্মের পরপরই প্রত্যেক নাগরিককে একটি নম্বরের আওতায় আনা যায় কি না, যে নম্বর ভবিষ্যতে তার জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক কার্ড হবে। সারাবিশ্বেই এই সংস্কৃতি আছে। প্রত্যেকের একটা নম্বর থাকে। আমি মনে করি সেই জিনিসগুলো মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশন যদি একটি প্রকল্প নিয়ে সবাইকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়, এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ হবে। প্রথমে তাদের পরিচয়পত্র দেওয়া হোক, এরপর তারা কীভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে সেটি আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চয়ই একটা উপায় বের হবে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না পাওয়ায় প্রবাসীদের এনআইডির কার্যক্রমটি শুরু করা যাচ্ছে নাÍএ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের নাগরিকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজটা নির্বাচন কমিশনেরই। যে কাজ যার সে কাজ তাকেই দেওয়া উচিত। বিদেশে কনস্যুলার সেবা দেওয়ার কাজটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এক্ষেত্রে তাদের যুক্ত করা যেতে পারে। যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় তারা কাজ করতে পারে। যাচাই-বাছাইয়ের কাজ যে খুব কঠিন হবে তাও নয়। যাচাই-বাছাইয়ের কাজে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা অন্য আরও দপ্তর যদি যুক্ত হতে চায়, সহায়তা করতে চায় সেটি অবশ্যই হতে পারে।’- জাগো নিউজ