ভারতে হাজার বছরের বহুমাত্রিক সমাজের ঐতিহ্য ও রেওয়াজ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ভারতবর্ষে বহু ধর্ম, জাতি, ও নৃগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের ধর্মবিশ^াস, ভাষা, সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্য একটি অপরটি থেকে পৃথক। ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত বহু শতবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও যুবা প্রাণ হারিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। ইন্দো-মুসলিম সভ্যতা নির্মাণে বৃহৎ দুই ধর্মাবলম্বীর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর পাশাপাশি মুসলিম জনগণ যে ত্যাগ ও কোরবানি দেন তা ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে উৎকীর্ণ রয়েছে। ভারত প্রায় ৭৬৬ বছর মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। বর্তমান শতকের ভারতে এখন সেই পর্বটাকেই ম্লান করে দেয়ার সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয়। আর স্পষ্টতই এর পেছনে আছে ধর্মীয় বিষোদগার ও ক্ষমতার রাজনীতির সমীকরণ। ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমেই। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পড়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। অবস্থা এভাবে চলতে থাকলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দ্বারা জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হতে পারে। এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববরেণ্য স্কলার শায়খ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি বলেন, ‘ভয়ঙ্কর ও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ভারতের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, দেশের স্বাধীনতায় তারা যে কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এবং আরো যেসব অমূল্য ত্যাগ ও কোরবানি দিয়েছেন এসব বিষয়কে ইদানীং উপেক্ষা করার, বরং অস্বীকার করার মানসিকতা জন্ম নিচ্ছে। ভারতের ইতিহাসকে পরিকল্পিতভাবে এমনভাবে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা চলছে, যেন মুসলমানদের যুগটা নিরেট এক প্রবাসী জাতির সাম্রাজ্যবাদীর যুগ বৈ কিছুই নয়, যার মধ্যে ভালো ও কল্যাণ বলতে কিছুই ছিল না। এ সময়ের মধ্যে উঁচু মানের কোনো ব্যক্তিত্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার দিক দিয়ে কোনো কৃতিত্ব প্রদর্শন করেননি এবং দেশ গড়ার ও জাতীয় উন্নয়নে এমন কোনো অনাবিল ও নির্দোষ কাজ হয়নি, যা নিয়ে ভারত গর্ব করতে পারে। দীর্ঘ স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের অথবা নির্লিপ্ত কোনো জাতির। ঘটনাক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিলেও তা অনুল্লেখ্য।
এভাবে ভারতের সবুজ শ্যামল, সদা বসন্তমুখর বৃক্ষের এক ফলদায়ক শাখাকে আমরা নিজেরাই বর্শাবিদ্ধ করে চলেছি এবং এটাই প্রমাণ করছি যে, আট শ’ বছর পর্যন্ত এ বৃক্ষ নিষ্ফল ছিল- দেশজুড়ে হেমন্তই শুধু বিরাজ করত (আল মুসলিমুনা ফিল হিন্দ, অনুবাদ ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, পৃ:৬-৭)।
বিজেপি-শাসিত ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে সপ্তম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের এখন থেকে মুঘল ইতিহাসের বদলে মারাঠা বীর শিবাজী ‘মহারাজের কাহিনীই পড়ানো হচ্ছে। এটা ভারতের ইতিহাস থেকে মুঘল শাসনের পর্বটাই মুছে দেয়ার চেষ্টা। মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে সমগ্র ভারতবর্ষ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন হিন্দু রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং এক রাজ্য অন্য রাজ্যের প্রতি শত্রুতার মনোভাব পোষণ করত। বাংলা ও দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ ছাড়া পুরো ভারতবর্ষকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আনে মুঘল সরকার। এই অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যর মধ্যে কাশ্মির, কনৌজ, আজমির, দিল্লি, বুন্দেলখ-, মালব, সিন্ধু, বাংলা, আসাম, পল্লব, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, পা-্য, চৌল ও চেরা উল্লেখযোগ্য।
‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র ভারতে বেশ ক’বছর ধরে বিভিন্ন এলাকা ও স্থাপনার মুসলিম নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এলাহাবাদের নাম বদলে ‘প্রয়াগরাজ’ ও ফৈজাবাদকে বদলে ‘অযোধ্যা’; রাজস্থান রাজ্যের বারমের জেলার ‘মিয়া কা বড়া’ গ্রামের নাম বদল করে করা হয়েছে ‘মহেশপুর’, ইসমাইলপুর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘পিচানবা খুর্দ’, মধ্যপ্রদেশের আজমগড়কে বলা হচ্ছে ‘আরইয়মগড়’, লক্ষেèৗ শহরের ‘বেগম হজরত মহল’ পার্ককে পাল্টে নাম রাখা হয় ‘ঊর্মিলা বাটিকা’, ২০১৮ সালে বিখ্যাত রেলওয়ে জংশন মুঘলসরাই-এর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে ‘দীনদয়াল’ নামে। প-িত দীনদয়াল উপাধ্যায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। ‘হুসাইন সাগর’ রূপান্তরিত হয়েছে ‘বিনায়ক সাগর’-এ। গুজরাটে আহমেদাবাদের নাম বদলে হয়েছে ‘কর্ণাবতী’। এ দিকে দক্ষিণের রাজ্য তেলেঙ্গানার বিজেপি সংসদ সদস্য রাজা সিং ইতোমধ্যে হায়দরাবাদের নতুন নাম হিসেবে প্রস্তাব করেছেন ‘ভাগ্যনগর’। এমনকি তাজমহলের জন্য বিশ্বখ্যাত শহর, আগ্রার নাম পরিবর্তন করে ‘অগ্রভান’ বা ‘অগ্রওয়াল’ করারও কথা শোনা যাচ্ছে। মুজফফরনগরকে ‘লক্ষ্মীনগর’ করার প্রস্তাবও উঠে এসেছে এর মধ্যে। ভারতের আসামের বিভিন্ন অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করা হবে বলে জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে দেশকে ‘হিন্দুকরণ’-এর প্রক্রিয়া।
সমাজতাত্ত্বিক সঞ্জয় শ্রীবাস্তব ডয়েচে ভেলেকে জানান, ‘এই নামবদল আসলে দেশের বহুমুখী সত্তার বিরোধী। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি দেশের গোঁড়া হিন্দু ভোটারদের তোয়াজ করতেই এমন কাজ করছে। কিন্তু এসবের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে যে বার্তা পৌঁছাচ্ছে, তা সঙ্কট তৈরি করবে।’ বিজেপির আদর্শ হলো, হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন আরএসএস। ১৯২৫ সালে মারাঠি চিকিৎসক কেশব হেডগেওয়ার সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠাই আরএসএস-এর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (ডয়েচে ভেলে, ১৩ নভেম্বর, ২০১৮)।
এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘হিজাব-বিতর্ক’। দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্নাটক রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ড্রেস কোডের বাধ্যবাধকতা জারি করে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশে বাধা দেয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে দেশজুড়ে। উদুপি জেলার একটি গার্লস কলেজে গেরুয়া উত্তরীয় গলায় ঝুলিয়ে একদল যুবকের প্রতিবাদের মুখে হিজাব পরা, মুসকান নামের এক ছাত্রী শ্রেণিকক্ষে ঢুকতে না পেরে ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিতে থাকে। এর ভিডিও গোটা দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। মুসলিম এক প্রভাষককে প্রিন্সিপাল হিজাব ত্যাগ করতে বলায় তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। হিজাব-বিতর্কের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। কর্নাটকের বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ছে মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গেও। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রদেশের দাতিয়া জেলার এক সরকারি কলেজে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মহিলা মোর্চা ‘দুর্গা বাহিনী’র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের হিজাব পরিধান নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আনন্দবাজার জানায়। ‘দুর্গা বাহিনী’র দাবি, কলেজ ক্যাম্পাসে মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরে আসতে পারবেন না। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হলো নতুন বিতর্ক।
যেসব মুসলিম মেয়ের হিজাবের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কর্নাটক হাইকোর্টে আবেদন করেছে তারা যুক্তি দিয়েছে যে, হেডস্কার্ফ পরা বিশ্বাসের একটি নির্দোষ অনুশীলন এবং নিছক ধর্মীয় জিঙ্গোইজম প্রদর্শন নয়। এটি তাদের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। ‘লাইভ-ল’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, কর্নাটক হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অধ্যাপক রবি বর্মা কুমার আদালতে বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্কৃতিকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রদর্শনের অনুমতি দেয় ভারতের বহুত্ববাদ।’ ইদানীং শুধু ধর্মীয় কারণেই মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। হিজাব কেন? এটি কি শুধু তাদের ধর্মের কারণে? মুসলিম মেয়েদের প্রতি বৈষম্য সম্পূর্ণরূপে তাদের ধর্মের ওপর ভিত্তি করে এবং এই বৈষম্যমূলক আচরণ সংবিধানের ১৫ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে। তিনি বলেন, শিখ পুরুষদের সশস্ত্রবাহিনীতে পাগড়ি পরতে দেয়া হয় যা একটি স্বীকৃত প্রথা। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের হিজাব পরায় বাধা কোথায়? (নয়া দিগন্ত অনলাইন ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২) কারোয়ার জেলার রামকৃষ্ণ আশ্রমের প্রধান পুরোহিত স্বামী ভবেশানন্দ বলেন, ‘স্কুল ও কলেজগুলোয় মুসলিম নারী শিক্ষার্থীদের পোশাকবিধি নিয়ে অপ্রয়োজনীয় এক আলোচনা চলছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এ বিষয়ে একটি তুমুল বিতর্কের সাক্ষী হয়ে আমি ব্যথিত। সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির স্বার্থে এটা অবশ্যই ভালো কোনো বিষয় নয়।’ এ ছাড়া রাজ্য সরকার কর্তৃক পরিচালিত আসামের ৬১০টি মাদরাসা ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলো এখন থেকে সাধারণ স্কুলের মর্যাদায় পরিচালিত হবে এবং স্কুল শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে থেকে তাদের কাজ করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার আর কোনো ব্যবস্থা থাকছে না। ১৭৮০ সালে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয়েছিল আসামে।
‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় গুজরাটে বৃদ্ধের হাত-পা ভেঙে দেয়া, পশ্চিমবঙ্গে যুবকের শরীরে গরম পানি ঢেলে দেয়া ছাড়াও উত্তরপ্রদেশে ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় এক মুসলিম কিশোরের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যার নৃশংস ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে রাজ্যের চানদেউলি জেলায়। উত্তরপ্রদেশের দাদরি এলাকার একটি গ্রামে বাড়ির ফ্রিজে ‘গোমাংস’ রাখার সন্দেহে আখলাক (৫০) নামের একজন মুসলিমকে পিটিয়ে মারে প্রায় ২০০ জনের এক হিন্দু উগ্রবাদী গোষ্ঠী। পুলিশ পরে সে গোশত ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেখেছে যে, তা গরুর নয়, পাঁঠার গোশত। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, চলতি মাসের ১৬ তারিখে বিহার প্রদেশে গরুর গোশত খাওয়ায় মোহাম্মদ খলিল আলম নামের এক মুসলিম যুবককে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করেছে গোরক্ষক কমিটির সদস্যরা।
হিন্দু মৌলবাদী সাভারকার এবং গোলওয়ালকারের সিদ্ধান্ত মতে ভারতকে পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে সরকারি নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী; নাগরিকপঞ্জি করতে গিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের নন-মুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর উত্তরাখন্ডের হরিদ্বারে বেদ নিকেতন ধামে ধর্মীয় নেতাদের বিশাল সমাবেশে ডানপন্থী কর্মী, কট্টর মৌলবাদী জঙ্গি এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ‘ধর্ম সংসদ’ নামে একটি অনুষ্ঠানের জন্য একত্রিত হলে ভারতে বসবাসরত ২০ কোটি মুসলমানকে নিধন ও ‘গণহত্যা’ (এথনিক ক্লিনজিং)-এর ডাক দেয়া হয়। উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের ডাসনা মন্দিরের পুরোহিত স্বামী নরেশানন্দ সরস্বতী মুসলমানদের নির্মূল করার মাধ্যমে ভারতকে ‘পরিষ্কার’ করার আহ্বান জানান। বিবিসির রিপোর্ট অনুসারে, দেশের প্রধান বিচারপতিকে লেখা এক খোলা চিঠিতে ৭৬ জন সিনিয়র আইনজীবী বলেন, এই গণহত্যার আহ্বানের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ খুব জরুরিÑ কারণ ভারতীয় প্রশাসন কিছুই করছে না। মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশটির রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেন দেশের পাঁচ সাবেক প্রতিরক্ষাপ্রধান। তারা বলেন, ‘দেশের স্বার্থে অবিলম্বে এর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ স্তরে কড়া ব্যবস্থা নেয়া দরকার। না হলে দেশের নিরাপত্তা প্রবলভাবে বিঘিœত হবে। দেশ এমনিতেই সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছাড়াও সীমান্ত পরিস্থিতি ভালো নয়। এ পরিস্থিতিতে হিন্দুত্ব রক্ষার নামে মুসলমান গণহত্যার আহ্বান দেশকে ভেতর থেকে নড়বড়ে তো করবেই, বহিঃশত্রুকেও উৎসাহিত করবে। দেশের একতা ও সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে তা উদ্বেগজনক। মুসলমান ছাড়াও খ্রিষ্টান, শিখ ও দলিতদেরও আক্রমণের লক্ষ্য করা হয়েছে।’ পাঁচ সাবেক প্রতিরক্ষাপ্রধানের এ উৎকণ্ঠা গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। এটা প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের পূর্বাভাস।
প্রখ্যাত ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এন এস মেহতার মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘ইসলাম ভারতবর্ষে একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা নিয়ে আসে, যা অন্ধকার থেকে মানবতাকে এমন সময় উদ্ধার করে যখন প্রাচীন সভ্যতা পতনোন্মুখ এবং উন্নত নৈতিক আদর্শগুলো কেবল নীরস বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও মুসলিম বিজয় রাজনীতির অঙ্গনের চেয়ে চিন্তা ও বুদ্ধির জগতে বিস্তৃতি লাভ করে। আজো মুসলিম বিশ্ব আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং মুসলমানরা তাওহিদ ও মানুষের সমতাকে একত্রে আঁকড়ে ধরে আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতে ইসলামের ইতিহাস শত বছর ধরে সরকারের হাতে বাঁধা। ফলে ইসলামের মূল চেতনায় পর্দা পড়ে গেছে এবং এর ফসল ও অবদান জনগণের চোখের আড়ালে চলে গেছে’ (Islam and the Indian Civilization, pp.316-317)।
জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি ও সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামষ্টিক ও ‘নিয়মতান্ত্রিক’ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আসন্ন গণহত্যা থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কেবল বক্তৃতা বিবৃতি ও আহ্বানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বকে নজর দিতে হবে। ভারতের সচেতন নাগরিক ও সুশীল সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। নইলে ধর্মোন্মাদনার আগুনের লেলিহান শিখার উত্তাপ ভারতের সীমা ছাড়িয়ে উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। অসহিষ্ণুতার উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক হিংস্্রতা মানবতার অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে। মিথ্যা অহমিকা, ক্ষমতার রাজনীতি ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ভারতকে অন্ধকারের পথে ঠেলে দিচ্ছে। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ আর কান্না ও আর্তনাদ শুনতে চায় না। দেখতে চায় না ধ্বংসযজ্ঞ। পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে উপমহাদেশের মানুষ বাঁচতে চায়। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক, ইমেইল: drkhalid09@gmail.com