রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১০:৫৭ পূর্বাহ্ন

বরকতময় সালাতে তাহাজ্জুদ

মুফতি আবদুল হক (ফকির)
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০২২

তাহাজ্জুদ প্রথম নবী হজরত আদম আ: থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত সব নবী-রাসূলের বৈশিষ্ট্য। যুগ-যুগান্তরে গাউস, কুতুব, ওলি-আবদালদের অভ্যাস ও আল্লাহ প্রেমিকদের বিশেষ অবলম্বন এবং দ্বীনের দায়িত্ব পালনে তাবলিগ ও দাওয়াহ কর্মীদের রুহানি জ্যোতি ও বিস্ময়কর ক্ষমতা অর্জনের বলিষ্ঠ মাধ্যম। পবিত্র কুরআনে তাহাজ্জুদ: মহাগ্রন্থ আল কুরআনে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে অনেক আয়াত এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, হে নবী! রাতের কিছু অংশে অতিরিক্ত নামাজ হিসেবে তাহাজ্জুদ পড়ুন অচিরেই আপনার প্রভু আপনাকে মাকামে মাহমুদের মধ্যে অধিষ্ঠিত করবেন। (সূরা বনি ইসরাইল-৭৯) মহান আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন, সেসব মুত্তাকির জন্য জান্নাত অনিবার্য, যারা ধৈর্যধারণকারী, সত্যবাদী, একান্ত অনুসারী, আল্লাহর পথে ব্যয়কারী এবং সাহরির সময় ক্ষমা প্রার্থনাকারী। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১৭) পবিত্র কুরআনে আরো এসেছে, রহমানের বিশিষ্ট বান্দারা হচ্ছেন তারা, যারা সিজদা ও দণ্ডায়মান (তাহাজ্জুদ) অবস্থায় রাত্রিযাপন করে। (সূরা ফোরকান, আয়াত-৬৫)
আল কুরআনের অনত্র এসেছে, মুমিনদের পাজর সাহরির সময় বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় (সূরা সাজদাহ-১৮) আল্লাহ পাক আরো বলেন, তারা (মুত্তাকিরা) বিশেষত সাহরির সময় ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সূরা মুজ্জম্মিলে ইরশাদ হয়েছে; হে চাদর আবৃত (রাসূল), রাত্রিকালে দণ্ডায়মান হোন (তাহাজ্জুদ পড়ুন)। (সূরা মুজ্জাম্মিল আয়াত-১/২) সূরা মুজ্জাম্মিলে আরো এসেছে, নিঃসন্দেহে আপনার প্রভু অবগত আছেন। আপনি এবং আপনার একদল মুমিন সাথীরা তাহাজ্জুদের জন্য (কখনো) রাত্রির প্রায় দু-তৃতীয়াংশে (কখনো) অর্ধ রাত্রে আবার (কখনো) রাত্রির এক-তৃতীয়াংশে দ-ায়মান থাকেন (সালাতে তাহাজ্জুদ আদায় করেন)। (সূরা মুজ্জাম্মিল-২০)
পবিত্র হাদিসে তাহাজ্জুদ : মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ঘরে-বাইরে-সফরে সর্বত্র অত্যন্ত যতেœর সাথে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। তাঁর মহীয়সী স্ত্রীদেরও নবীজী তাহাজ্জুদের জন্য ঘুম থেকে তুলে দিতেন এবং সাহাবিদেরকে সালাতে তাহাজ্জুদের ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহ-প্রেরণা জোগাতেন-গুরুত্বারোপ করতেন। নবী করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘জান্নাতে এমন একটি প্রাসাদ রয়েছে যার ভেতর থেকে বাইরে এবং বাইর থেকে ভেতরে সব কিছু দেখা যাবে। অর্থাৎ একদম গ্লাস ফিটিং হবে। আল্লাহ পাক এটি তৈরি করেছেন সেসব লোকের জন্য যারা- ১. বিনম্র্র স্বরে কথা বলে; ২. মানুষকে খাবার বিলায়; ৩. রাতের বেলায় (তাহাজ্জুদ) নামাজ পড়ে যখন মানুষ ঘুমায়।’ (বায়হাকি)
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেতে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি মহানবী সা: থেকে শুনেছি, ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ শেষ রাতের নামাজ (মিশকাত)। মহানবী সা: আরো ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ সেই স্বামীকে রহমত করুক যে তাহাজ্জুদের জন্য নিজে উঠল এবং তার স্ত্রীকেও তুলে দিলো। যদি স্ত্রী উঠতে না চায় তখন তার মুখে পানি ছিটায়। আর আল্লাহ পাক সেই স্ত্রীকেও রহমত করুক যে তাহাজ্জুদের জন্য নিজে উঠল এবং স্বামীকেও ডেকে দিলো। যদি সে উঠতে না চায় তখন তার মুখে পানি ছিটাল।’ (আবু দাউদ) অন্য এক হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা তাহাজ্জুদ নামাজ অনিবার্য করো, কারণ এটি তোমাদের পূর্ববর্তী আল্লাহ ওয়ালাদের বৈশিষ্ট্য। তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের মাধ্যম এবং তোমাদের গুনাহগুলোর কাফফারা ও তোমাদেরকে গুনাহ থেকে নিবৃতকারী।’ (তিরমিজি)
বলাবাহুল্য, তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়িয়ে নবী করিম সা: এমন আত্মনিয়োগ করতেন; দীর্ঘক্ষণ কিয়াম ও রুকু করতেন যে, তাঁর কদম মোবারক ফুলে যেত। মুগিরা ইবনে শোয়বা রা: বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা: (তাহাজ্জুদের নামাজে) এত দীর্ঘ কেয়াম করলেন যে, তার কদম মোবারক ফুলে গেল। আরজ করা হলো- ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: আল্লাহ পাক তো আপনার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। প্রতি উত্তরে নবী করিম সা: বললেন, তাই বলে কী আমি কৃতজ্ঞ বান্দাহ হবো না? (বোখারি ও মুসলিম) হজরত আবু হুরায়রা রা: সূত্রে বর্ণিত- একটি হাদিসে এসেছে, ‘মহান আল্লাহ রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার (নি¤œ) আসমানে অবতরণ করেন। আর ডেকে ডেকে বলেন, কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করতাম। কেউ রিজিক অন্বেষণকারী আছে কি? আমি তাকে দান করতাম। কেউ বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করতাম। এরূপ সুবেহ সাদিক পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।’ (মিশকাত) তাহাজ্জুদ সুন্নাত না নফল : ইসলামের প্রারম্ভকালে তাহাজ্জুদ ফরজ ছিল। অতঃপর মিরাজ রজনীতে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হলে তাহাজ্জুদের ফরজিয়াত রহিত হয়ে যায়। তবে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ হওয়াই যুক্তিযুক্ত বলে তাফসিরে মুজহেরি ও তাফসিরে মায়ারেফুল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। নির্ভরযোগ্য ফতোয়ার কিতাবসমূহে তাহাজ্জুদকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ লিপিবদ্ধ করা হলেও কেউ কেউ এটিকে নফলের অন্তর্ভুক্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
তাহাজ্জুদ কত রাকাত : এ প্রসঙ্গে বোখারি ও মুসলিম শরিফের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, নবী করিম সা: সাধারণত আট রাকাত সালাতে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। আর কোনো কোনো বর্ণনা থেকে চার রাকাত অনুমিত হয়। (মায়ারিফুল কুরআন-৫/৫১৮)
তাহাজ্জুদের সময় : মহানবী সা: এবং সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য ছিল শেষ রাতে নিদ্রা জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ আদায় করা। (মায়ারিফুল কুরআন) তাই এটিই তাহাজ্জুদের উত্তম সময়। তবে তাফসিরে মুজহেরি মতে, নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে নফল নামাজ পড়া কিংবা নিদ্রার আগে নফল নামাজ পড়া উভয়টি তাহাজ্জুদ বলে গণ্য হবে।
তাহাজ্জুদ আল্লাহ প্রেমিকদের প্রিয় আমল : যুগ-যুগান্তরে আল্লাহ প্রেমিকদের বিশেষ আমল হচ্ছে সালাতে তাহাজ্জুদ। রোমান সম্র্রাটের বিশেষ দূত মদিনা শরিফ থেকে প্রত্যাবর্তন করে রিপোর্ট করেছিলেন যে, ‘সাহাবারা দিনে ঘোড় সওয়ার আর রাতে ইবাদত গুজার’। আল্লামা রুমির মতে, আল্লাহ প্রেমের লক্ষণ হচ্ছে- সাহরির আহাজারি’। বিশ^বরেণ্য দ্বায়ী হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ: বাল্যকাল থেকে তাহাজ্জুদ ধরে ছিলেন যে, আমরণ কাজা করেননি। (আশরাফুচ্ছওয়ানেখ, পৃষ্ঠা-১৬)
বালাকোটের শহীদ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভি র.-এর সৈনিকরা সবাই তাহাজ্জুদ গুজার ছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য। আমাদের পূর্ববর্তী বুজুর্গানে দ্বীন সবাই তাহাজ্জুদের নামাজ এবং জিকির আসকার বাধ্যতামূলক করতেন। দয়াময় আল্লাহ আমাদেরও সালাতে তাহাজ্জুদ এবং সাহরিতে আল্লাহকে স্মরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক: কলামিস্ট ও গ্রন্থ প্রণেতা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com