জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশ চরম উষ্ণতা ও আদ্রতা ঝুঁকি, সমুদ্র পানির উচ্চতা বৃদ্ধির মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে এবং এর কারণে লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যূতির আশঙ্কা রয়েছে পাশাপাশি শিল্প ও কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে। আইপিসিসি’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ আভাস দেয়া হয়েছে। জলবায়ুর প্রভাব প্রশমনের ওপর জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) ওয়ার্কিং গ্রুপ ২ এআর৬ এর প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যে সব প্রকল্পে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ অব্যাহত রয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির প্রতি হুমকি সৃষ্টি করবে এবং এর ফলে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মক অভিঘাতের সম্মুখীন হতে পারে যা প্রবৃদ্ধিকে থমকে দিবে।
প্রতিবেদনটির প্রধান লেখকদের অন্যতম সমন্বয়কারী ড. রওশন আর বেগম বলেন, ‘এই প্রতিবেদনে আভাস দেয়া হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র পানির স্তর বৃদ্ধির কারণে শতাব্দীর মাঝামাঝি বা শেষের দিকে বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১ থেকে ২ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যূত হতে পারে।’
অতি-দারিদ্র্য, আয় বৈষম্য, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষতি এবং নি¤œ অভিযোজন সক্ষমতাসহ দেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো আরো কঠিন হয়ে পড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধান উৎপাদন ১২ থেকে ১৭ শতাংশ ও গম উৎপাদন ১২ থেকে ৬১ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে।
আইপিসিসি প্রতিবেদনটির অন্যতম প্রধান লেখক মো. আরফানুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব মোকাবেলা করছে, আগামী বছরগুলোতে তারচেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এমনটা হবার সম্ভাবনাই প্রবল যে, আমাদের অধিকাংশ অভিযোজন পদক্ষেপই ১.৫ ও ২ সে. উষ্ণতায় অকার্যকর হয়ে পড়বে।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান নিঃসরণ পরিকল্পনার কারণে এই শতাব্দীতে সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধি পাবে। আর এর ফলে দেশের কিছু অংশের কৃষি জমির ৩১-৪০ শতাংশ তলিয়ে যাবে। সমুদ্র পানির স্তর বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট বন্যা এড়াতে আগামী দশকে দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ পরিকল্পনার পুনঃবিন্যাস করতে হতে পারে। অধিকন্তু, প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে অবস্থিত, যেখানে দ্রুত কার্বণ নিঃসরণ বন্ধ করা না হলে অসহিষ্ণু উষ্ণতা ও আদ্রতা দেখা দিবে। যদি নিঃসরণ বৃদ্ধি পেতেই থাকে, তবে চলতি বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের কিছু অংশের উষ্ণতা ও আদ্রতা মানুষের সহনশীলতার মাত্রা অতিক্রম করবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ পানি সংকটে পড়বে। বর্তমানে প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ পানি সংকটে রয়েছে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকায় ক্রমবর্ধমান বন্যার সৃষ্টি হবে।
এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন, বাজার, অর্থনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, বাংলাদেশে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশী রপ্তানিও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ক্ষতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হ্রাস পেতে পারে।
ড. রওশন বলেন, ‘প্রমাণ রয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্র পরিবার, গোষ্ঠী ও বিভিন্ন দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এদের দায় খুবই কম। অন্যদিকে, এরা অভিযোজনের জন্য খুবই কম আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নের উচিৎ স্বল্প উন্নয়ন ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অর্থায়নের জন্য অধিকতর মনযোগী হওয়া।’
এই প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেয়ার পাশাপাশি ঝুঁকি হ্রাস ও স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধির জন্য অভিযোজনের পন্থাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
ড. রওশন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক হুমকি ও বৈষম্য একটি বৈশ্বিক সমস্যা। একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের নাগরিক হিসেবে আমি আশা করি যে, বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দ জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাসে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ দ্রুত ও ব্যাপক হ্রাস পাবে।’