মুসলিম সমাজের সুফি ও আধ্যাত্মিক ধারায় ‘মুরাকাবা’ একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। আল্লাহর নৈকট্য লাভে সুফি সাধক আলেমরা মুরাকাবাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কোরআনের একাধিক আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদিসে মুরাকাবার মূল ধারণার সমর্থন পাওয়া যায়। গবেষক আলেমরা মুরাকাবাকে ঈমানের উচ্চতর প্রতিফলন আখ্যা দিয়েছেন।
মুরাকাবার পরিচয় : মুরাকাবার শাব্দিক অর্থ সঙ্গী হওয়া। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) লেখেন, ‘মুরাকাবা হলো এই বিষয়ে বান্দার সার্বক্ষণিক জ্ঞান ও বিশ্বাস যে, তিনি তার ভেতর ও বাহির সম্পর্কে অবগত। বান্দার এই জ্ঞান ও বিশ্বাস তার অপর একটি জ্ঞানের প্রতিফল। তা হলোÍআল্লাহ তার সঙ্গী, তিনি তাকে দেখেন, তার কথা শোনেন, তার প্রতি মুহূর্তের কাজ সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। ’ (মাদারিজুস সালিক : ২/১৪৮৯)
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদের সঙ্গেই আছেন তোমরা যেখানেই থাকো। ’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ৪)
মুরাকাবার মূল ভিত্তি : প্রাজ্ঞ আলেমরা মহান আল্লাহর তিনটি গুণবাচক নামকে মুরাকাবার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তা হলো
ক. আলিমুন বা সর্বজ্ঞাত : আল্লাহ সব কিছু জানেন। পৃথিবীর কোনো কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা জেনে রাখো যে নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের মনোভাব জানেন। সুতরাং তাঁকে ভয় করো। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৫)
খ. বাসিরুন বা সর্বদ্রষ্টা : আল্লাহ সৃষ্টিজগতের সব দেখেন এবং কোনো কিছু তাঁর অগোচরে নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা পরস্পরের কাছে যাচ্ঞা করো এবং সতর্ক থাকো আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষ দৃষ্টি রাখেন। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১)
গ. সামিউন বা সর্বশ্রোতা : আল্লাহ সব কিছু শোনেন। কোনো কিছু তাঁর শ্রবণশক্তির বাইরে নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু শোনেন এবং জানেন। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮১)
মুরাকাবার স্তর : সুফি সাধক আলেমরা আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস দ্বারা মুরাকাবার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তর নির্ধারণ করেছেন, যাতে বলা হয়েছে, আপনি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবেন, যেন আপনি তাঁকে দেখছেন। আর যদি আপনি তাঁকে দেখতে না পান, তাহলে (মনে করবেন) তিনি আপনাকে দেখছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০)
তাঁরা বলেন, প্রথম অবস্থাটি মুরাকাবার সর্বোচ্চ স্তর এবং দ্বিতীয় অবস্থাটি মুরাকাবার সর্বনিম্ন স্তর। এর মধ্যে অনুভূতির একাধিক স্তর আছে।
মুরাকাবার উদ্দেশ্য : ইমাম নববী (রহ.) বলেন, মুরাকাবার উদ্দেশ্য হলো ইবাদতে নিষ্ঠা অর্জন করা। বান্দা তার মহান প্রতিপালকের মুরাকাবার মাধ্যমে খুশু ও খুজু (আল্লাহর সামনে ও তাঁর জন্য বিনয় ও নম্রতা) অর্জন করে। (শরহু সহিহ মুসলিম : ১/১৫৮)
মুরাকাবার সুফল : ইমাম ইবনু কায়্যিম (রহ.) বলেন, তরিকাপন্থী (সুফি) আলেমরা একমত যে অন্তরে আল্লাহর মুরাকাবা (স্মরণ ও চিন্তা) বান্দার বাহ্যিক আচরণকে সংযত করে। সুতরাং যে ব্যক্তি গোপনে আল্লাহর মুরাকাবা করে, আল্লাহ গোপনে ও প্রকাশ্যে তার আচরণকে সংরক্ষণ করেন। মহান আল্লাহ যেমনটি বলেছেন ‘আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মপরায়ণ। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৮; মাদারিজুস সালিকিন : ২/১৪৯২)
যেভাবে মুরাকাবা করবেন : উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে মুরাকাবা মুমিনের সার্বক্ষণিক ইবাদত। তবে তরিকাপন্থী আলেমরা মুরাকাবার নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতির কথা বলেন। যেমন প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় ফরজ নামাজের পর কিছু সময় জিকির ও তিলাওয়াতের পর কেবলা দিকে ফিরে চারজানু হয়ে বসে মহান আল্লাহর বড়ত্ব এবং নিজের ক্ষুদ্রতা চিন্তা করা। তাসাউফের তরিকাভেদে তাতে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ আলেম বলেন, সালিক (আল্লাহর পথে সাধনাকারী) মুরাকাবার মাধ্যমে নিম্নোক্ত স্তরগুলো ধারাবাহিকভাবে অতিক্রমের চেষ্টা করবে। যাতে তার চিন্তা, উপলব্ধি ও অনুভবের উন্নতি হয়। তা হলো:
১. ঈমান থেকে ভালোবাসা : আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক ঈমান, আনুগত্য ও ভালোবাসার। আল্লাহর প্রতি যে বান্দার ঈমান যত দৃঢ়, তার আল্লাহপ্রেম তত প্রবল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৬৫)
মুমিন আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। কেননা আল্লাহই বান্দার সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার ঘাড়ের রগ অপেক্ষা নিকটতর। ’ (সুরা : কফ, আয়াত : ১৬)
২. ভালোবাসা থেকে স্মরণ : আল্লাহ বান্দার অতি সন্নিকটে। তাই বান্দা কখনো আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। আল্লাহর স্মরণে সে সতেজ থাকে। আল্লাহ মুমিনের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলেন, ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১)
৩. স্মরণ থেকে ভাবনা ও পরিচয় : মুমিন বান্দা যেহেতু আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে এবং রাত-দিন তাঁর স্মরণে নিমগ্ন থাকে। তাই মুমিনের ভাবনার জগতে আল্লাহ-চিন্তার প্রাবল্য থাকে। সে আল্লাহর সুনিপুণ সৃষ্টিজগৎ থেকে তাঁর পরিচয় খুঁজে পায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘(যারা) আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি, আপনি পবিত্র, আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১)
৪. পরিচয় থেকে আনুগত্য : আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে বান্দা যখন আল্লাহর পরিচয় লাভ করে, তখন তার সামনে মহামহিম আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদের পাপ ক্ষমা করুন, আমাদের মন্দ কাজগুলো দূর করে দিন এবং আমাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের সহগামী করে মৃত্যু দিন। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯৩)
মুরাকাবারত ব্যক্তির অবস্থা : যে ব্যক্তি যথা নিয়মে আল্লাহর মুরাকাবায় আত্মনিয়োগ করবে। সে নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত অবস্থা নিজের মধ্যে খুঁজে পাবে। তার অনুভূতিও হবে অনুরূপ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি লক্ষ করো না আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন? তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোনো গোপন পরামর্শ হয় না, যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকেন না এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যেও হয়, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকেন না। তারা এর চেয়ে কম হোক বা বেশি হোক, তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। অতঃপর তারা যা করে, তিনি তাদের কিয়ামতের দিন তা জানিয়ে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত। ’ (সুরা : মুজাদালা, আয়াত : ৭) আল্লাহ সবাইকে তাঁর স্মরণের সৌভাগ্য দান করুন। আমিন।