একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নানামাত্রিক লেনদেন থাকে। থাকে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম। থাকে অন্যান্য ব্যাংকিং সেবা। আধুনিক অর্থব্যবস্থায় ব্যাংককে বলা হয় ক্যাশ মার্কেট। এই ক্যাশ সে জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের সরবরাহ করে থাকে। এখানে ব্যাংক অবস্থান করে সেতুবন্ধ হিসেবে। কিন্তু তাকে নিতে হয় প্রচ- ঝুঁকি। জনগণের ক্যাশ চাহিবামাত্র ফেরত দিতে পারা-না-পারার ঝুঁকি। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের সরবরাহকৃত ক্যাশ সুদে-আসলে উদ্ধার করতে পারা না পারার ঝুঁকি। এই ঝুঁকি নিরসনের জন্য সে নেয় জামানত। আর ঝুঁকি নেয়ার রিওয়ার্ড হিসেবে সে পায় সুদ। এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কিন্তু যখন সে তার নৈতিক অবস্থান বদল করে সুদ ভিত্তিক ব্যাংকিং ছেড়ে শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকিং করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার সামনে এসে হাজির হয় অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জের অন্যতম হলো বিদ্যমান জামানত সংশোধন, বিদ্যমান শরিয়াহ অননুমোদিত আয় ছেড়ে দেয়া এবং বিগত বছরগুলোর অনাদায়ী জাকাত পরিশোধ করা বা না করা। আজকের নিবন্ধে এ তিনটি বিষয়ে ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো।
শরিয়াহ অননুমোদিত জামানতের কী হবে? শরিয়াহ অননুমোদিত কোনো জামানত ব্যাংকের সম্পদে যুক্ত হয়ে থাকলে শেয়ারহোল্ডাররা সেগুলো অবমুক্ত করে দেবেন। বাইরের কেউ কিনে নিয়ে রূপান্তর করলে ক্রেতা এই শর্তারোপ করবেন যে, বিক্রেতাকে শরিয়াহ অননুমোদিত জামানত পরিবর্তন করে শরিয়াহ অনুমোদিত জামানত গ্রহণ করতে হবে। এটি এ জন্য যে, সুদের লেনদেনের লেখক হওয়া ও সাক্ষী হওয়ার চেয়ে সুদ পরিশোধের জন্য ব্যক্তিগতভাবে জামিনদার হওয়া ও মর্গেজ দেয়া অনেক বেশি ভয়াবহ পাপ। রাসূলুল্লাহ সা: সুখখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক ও সুদের সাক্ষীদ্বয়- সবাইকে আল্লাহ তায়ালা লানত দিয়েছেন এবং বলেছেন, তারা সমান পাপী। সহিহ মুসলিম (৩ : ১২১৯)। লানত মানে হলো, আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত করার জন্য বদ দোয়া করা।
তবে কুরআন ও সুন্নাহ ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে জামানত গ্রহণের অনুমোদন রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন : যদি তোমরা সফরে থাক এবং কোনো লেখক না পাও তবে হস্তান্তরকৃত জামানত রাখবে। তোমাদের একে অপরকে বিশ্বাস করলে, যাকে বিশ্বাস করা হয়, সে যেন আমানত প্রত্যর্পণ করে এবং তার প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করে। -বাকারাহ (২): ২৮৩। রাসূলুল্লাহ সা: জামানত দিয়ে ঋণ গ্রহণ করতেন বলে জানা যায়।
অননুমোদিত আয়ের কী হবে? সনাতন ব্যাংক হতে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরের আগে অর্জিত যেসব আয় শরিয়তের বিধান মতে বর্জন করা উচিত অবিলম্বে সেগুলো দান করে দিতে হবে। কারণ মালিকানা পরিবর্তনের কারণে সম্পদের বৈধতা-অবৈধতার অবস্থানও পরিবর্তন হয়ে যায়। একটি বস্তু একজনের জন্য হারাম হলে অন্যের জন্য হারাম নাও হতে পারে। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ওংষধসরপ ঋরয়য অপধফবসু তাদের এক রায়ে বলেছে, শরিয়াহ অননুমোদিত আয় বা সম্পদ সাদাকাহ করে দিলে তার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে যায়। সে সাথে তার হারাম হওয়ার বৈশিষ্ট্যও পাল্টে যায়। ফলে তা যাকে দান করে দেয়া হলো তার জন্য জায়েজ হয়ে যায়। সুনানে দারে কুতনিতে (৪ : ২৮৫) এর সমর্থন পাওয়া যায়, যেখানে রাসূলুল্লাহ সা: অন্যায়ভাবে অধিকৃত ছাগলের গোশত যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে দিতে বলেছেন। – সুনান আল-দারে কুতনি (৪: ২৮৫); এবং নাইল আল-আওতার (৯: ১৮)।
এখন অননুমোদিত সব আয় ছেড়ে দিতে গেলে যদি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সেটি ভিন্ন কথা। এরূপ ক্ষেত্রে রূপান্তর কাজ পর্যায়ক্রমে করা ভালো। আল্লাহ তায়ালা বলছেন: কেউ ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফরির জন্য ‘মুক্তমনা’ হলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর গজব এবং তার জন্য আছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত থাকে ঈমানে অবিচল। – নাহল (১৬): ১০৬। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতের ভুলভ্রান্তি ও বাধ্য হয়ে করা অন্যায় কাজ মাফ করে দেবেন। – সুনানে ইবনে মাজাহ (১ : ৬৯৫)।
যে কোনো ধরনের সুদ ও অনান্য অননুমোদিত আয় সাদাকাহ করে দেয়া অথবা জনকল্যাণে ব্যয় করা উচিত। ব্যাংকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বার্থে এ টাকা ব্যয় করা জায়েজ হবে না। সাদাকাহ ও জনকল্যাণমূলক খাতের কয়েকটি উদাহরণ হলো : ব্যাংকের কর্মী ছাড়া সাধারণ জনগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা, গবেষণামূলক কাজে অর্থসহায়তা করা, ত্রাণ বিতরণ করা, মুসলিম দেশগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা, ইসলামী বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করা, ইসলামী জ্ঞানচর্চা প্রতিষ্ঠান ও এ-জাতীয় অন্যান্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা ইত্যাদি। দানের অর্থ এসব কাজে ব্যয় করতে হবে ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির নির্দেশনা মোতাবেক। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : তোমরা যদি না জান তবে আহলে জিকর (জ্ঞানী)দের জিজ্ঞাসা কর। – নাহল (১৬): ৪৩।
অনাদায়ী জাকাতের কী হবে? বাইরের কেউ কোনো সনাতন ব্যাংক কিনে নিয়ে তাকে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তর করলে তাদের ওপর পূর্ববর্তী অর্থবছরগুলোর জাকাত পরিশোধের দায়িত্ব বর্তাবে না; পূর্ববর্তী সময়ের অপরিশোধিত যাকাত পরিশোধের দায়িত্ব পূর্ববর্তী মালিকগণের ওপর বলবৎ থাকবে। যে তারিখে ব্যাংক রূপান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সেই তারিখ হতে প্রদেয় জাকাত পরিশোধ করতে হবে নতুন মালিকদের। আউফির ৩৫ নম্বর শরিয়াহ স্টান্ডার্র্ডে জাকাত পরিশোধের পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য জাকাত বেইজ চিহ্নিত করা হয়েছে; জাকাতযোগ্য বিভিন্ন প্রকার সম্পদ ও দায় নির্দেশ করা হয়েছে এবং জাকাত পরিশোধের হার ও খাত বর্ণনা করা হয়েছে।
ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা নিজেরাই তাদের ব্যাংকটিকে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে পূর্ববর্তী বছরগুলোর অপরিশোধিত জাকাত তাঁদেরই পরিশোধ করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, পূর্ববর্তী সময়ের আয় ও অর্জিত অর্থ যদি শরিয়তের দৃষ্টিতে অননুমোদিতও হয় তবুও তার ওপর জাকাত পরিশোধ করতে হবে। কারণ শেয়ারহোল্ডাররা প্রথমত সব অর্জিত সুদ ও অন্যান্য অননুমোদিত আয় ছেড়ে দিতে বাধ্য। জাকাত পরিশোধ এ বাধ্যবাধকতারই অংশ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলছেন : ওদের সম্পদ হতে সাদাকাহ গ্রহণ করবে। এর মাধ্যমে তুমি ওদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে। তুমি ওদের জন্য দোয়া করবে। তোমার দোয়া তো তাদের জন্য মানসিক প্রশান্তিদায়ক। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। – তাওবা (৯): ১০৩। ইনশা আল্লাহ, পরবর্তী প্রবন্ধে আলোচিত হবে, ‘প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরের কারণ’। লেখক: সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং