গত দুই বছর ধরে করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংকের ঋণ আদায়ের শিথিলতা ছিল। এতে ব্যাংকগুলোর নগদ আদায় কমে গিয়েছিল। আবার যে পরিমাণ প্রণোদনার ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল তার বেশির ভাগই আদায় হচ্ছে না। তবে, এতদিন বিনিয়োগের চাপ না থাকায় ব্যাংকগুলোর তেমন সমস্যা হয়নি; কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এরই প্রভাব পড়েছে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ওপর। ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো প্রায় প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে নগদ স্থানীয় মুদ্রার বিনিময়ে ডলার বিক্রি করছে। এতে ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের সঙ্কট আরো বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের ২৪ মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ আট মাস ২৪ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৩৭৯ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার বিক্রি করেছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে তুলে নিয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অপর দিকে আমানতপ্রবাহ কমে গেছে। সবমিলেই কিছু কিছু ব্যাংকের নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে টাকা ধার করছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি না করলে সামনে কিছু কিছু ব্যাংকের নগদ টাকার সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে। তখন চার্জ বাড়িয়ে বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়াতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়ায় চার্জ বাড়ানোর বিকল্প ব্যাংকের হাতে থাকবে না। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এমনিতেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো বাজার থেকে টাকার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। এক দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন প্রণোদনা তহবিলের অর্থ ছাড়ের জন্য বাজারে নগদ টাকার সরবরাহ বাড়াচ্ছে। ডলার বিক্রি করে ৩৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া না হলে মুদ্রাসরবরাহ আরো বেড়ে যেত। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যেত বলে ওই সূত্র মনে করছে।
মার্কিন ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় সঙ্কট বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে। আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় ব্যাংকগুলো দ্বারস্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের কিছু কম সময়ে (জুলাই-২৪ মার্চ) কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের ৩৭৯ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার বিক্রি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সামনে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাবে; কিন্তু ডলারের আন্তঃপ্রবাহে তেমন উন্নতি হবে না। এ কারণে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির চাপ আরো বাড়বে। বাধ্য হয়ে সমন্বয় করা লাগবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। সর্বশেষ ২২ মার্চ ডলারের দাম বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও ব্যাংকগুলো পণ্য আমদানিতে বিক্রি করছে ৮৭ টাকা থেকে ৮৮ টাকা পর্যন্ত।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে; কিন্তু সে তুলনায় রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, যেখানে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ সেখানে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ এবং রফতানি আয় বেড়েছে ৫৩ শতাংশ হারে। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় এ ফারাক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনে সমন্বয় করছে। এতে দুই ধরনের সমস্যা হচ্ছে। এক দিকে ডলার কিনতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নগদ টাকা সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের নগদ তহবিলে টান পড়ছে। আর নগদ তহবিলের টান পড়ায় ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে কলমানি মার্কেট থেকে ধার নিতে হচ্ছে। এভাবেই মুদ্রাব্যবস্থাপনা করতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপকরা হিমশিম খাচ্ছেন।