তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে সাড়ে তিনশো কোটি টাকার ওপরে তুলে নিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপের কারণে সম্প্রতি এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দামেও হয়েছে পতন। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক শেয়ারবাজারে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১২টি বহুজাতিক কোম্পানির বড় অংকের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বর্তমান (৩০ জুন) বাজার দরে এসব শেয়ারের মূল্য ৩৫০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। বিপরীতে একটি প্রতিষ্ঠানের কিছু শেয়ার কিনেছেন তারা। এ প্রতিষ্ঠানটি হলো হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। গত বছরের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের দশমিক ৫৯ শতাংশ ছিল বিদেশিদের কাছে। মে মাস শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি বছরের পাঁচ মাসে বিদেশিরা নতুন করে কোম্পানিটির ৫ হাজার ৬৫০টি শেয়ার কিনেছেন। বর্তমান বাজারদরে যার মূল্য ১১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। চলতি বছরের পাঁচ মাসে বিদেশিরা সব থেকে বেশি বিক্রি করেছে মোবাইলফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের শেয়ার। পাঁচ মাসে কোম্পানিটির ৪৭ লাখ ২৬ হাজার ৫০টি শেয়ার বিক্রি করেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বর্তমান বাজারমূল্যে বিদেশিদের বিক্রি করা এসব শেয়ারের মূল্য ১৩৮ কোটি ৯৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা। বিদেশিদের বড় অংকের শেয়ার বিক্রির কারণে কোম্পানিটির শেয়ার দামেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৩৫৯ টাকা ৪০ পয়সা। তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ২৯৪ টাকা ১০ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৬৫ টাকা ৩০ পয়সা।
বহুজাতিক কোম্পানি থেকে বিদেশিদের সর্বোচ্চ টাকা তুলে নেওয়ার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ম্যারিকো বাংলাদেশ। সম্প্রতি কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করে বিদেশিরা ৭৭ কোটি ৭৮ হাজার ৬৭ টাকার ওপরে তুলে নিয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত সময়ে কোম্পানিটির ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বা ৩ লাখ ২১ হাজার ৩০০টি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে বিদেশিরা। এতে বিদেশিদের কাছে কোম্পানিটির শেয়ার ধারণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩৩ শতাংশে।
তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটিএ)। কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে ৭৬ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টাকার ওপরে তুলে নিয়েছে বিদেশিরা। চলতি বছরের পাঁচ মাসে কোম্পানিটির ১৪ লাখ ৪ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছে তারা। এতে বর্তমানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের কাছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির ৮ দশমিক ১০ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে।
বিদেশিদের এমন বিক্রির চাপের কারণে কোম্পানিটির শেয়ার দামে বড় পতন হয়েছে। পাঁচ মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে একশো টাকার ওপরে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৬৭২ টাকা ৪০ পয়সা। ধারাবাহিকভাবে কমে তা এখন ৫৪৩ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে গেছে। সিঙ্গার বাংলাদেশের শেয়ার বিক্রি করেও বাজার থেকে মোটা অংকের টাকা তুলে নিয়েছেন বিদেশিরা। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে কোম্পানিটির ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বা ১০ লাখ ১৬ হাজার ৯৬৯টি শেয়ার বিক্রি করেছে বিদেশিরা। বর্তমান বাজার দরে বিদেশিদের বিক্রি করা এসব শেয়ারের মূল্য ১৬ কোটি ৫৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এখন কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের কাছে, যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিরামিক খাতের একমাত্র বহুজাতিক কোম্পানি আরএকে সিরামিকসের ওপর যেন কোনো ভরসাই রাখতে পারছেন না বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বিদেশিদের কাছে কোম্পানিটির যে শেয়ার ছিল তার সবই চলতি বছরে বিক্রি করে দিয়েছে। এ কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করে ১২ কোটি ৪৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন বিদেশিরা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির দশমিক ৫৯ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে, এখন তা শূন্য হয়ে গেছে।
লিন্ডে বাংলাদেশও যেন বিদেশিদের আস্থা কেড়ে নিয়েছে। এ কোম্পনিটি থেকেও সম্পূর্ণ বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। গত ডিসেম্বরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার ছিল, তা এখন শূন্য। বর্তমান বাজারদরে বিদেশিদের বিক্রি করা এসব শেয়ারের মূল্য ১০ কোটি ৯৯ লাখ ৫২ হাজার টাকা।
দেশের বাজারে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা রঙ কোম্পানি বার্জারের শেয়ার বিক্রি করে সম্প্রতি ৮ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার ওপরে তুলে নিয়েছেন বিদেশিরা। গত বছরের মার্চে কোম্পানিটির দশমিক ২৩ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে। চলতি বছরের মে মাস শেষে তা কমে দশমিক ১৩ শতাংশে চলে এসেছে। অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির যে শেয়ার ছিল তার প্রায় অর্ধেক বিক্রি করে দিয়েছেন তারা। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বা ৫ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭টি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা। বর্তমান বাজারদরে এসব শেয়ারের মূল্য ৩ কোটি ৯৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির দশমিক ৬৯ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে, মে মাস শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৬৪ শতাংশে।
বাটা সু’র শেয়ার বিক্রি করে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৫৬ কোটি টাকার ওপরে তুলে নিয়েছেন বিদেশিরা। গত বছরের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির ১ দশমিক ৮১ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে। চলতি বছরের মে মাস শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে কোম্পানিটির দশমিক ২৩ শতাংশ বা ৩১ হাজার ৪৬৪টি শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশিরা।
মোবাইল ফোন অপারেট রবি’র শেয়ার বিক্রি করেও কোটি টাকার ওপরে তুলে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিদেশিদের কাছে কোম্পানিটির যে শেয়ার ছিলো তার সবই বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির দশমিক শূন্য এক শতাংশ শেয়ার বিদেশিদের কাছে থাকলেও এখন তা শূন্য। প্রতিষ্ঠানিটর শেয়ার বিক্রি করে বিদেশিরা ১ কোটি ৫৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন।
দেশের পুঁজিবাজারের সব থেকে দামি রেকিট বেনকিজারের শেয়ারও বিক্রি করেছেন বিদেশিরা। চলতি মাসের পাঁচ মাসে বিদেশিরা কোম্পানিটির ১ হাজার ৮৯০টি বা দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন। এতে বর্তমানে কোম্পানিটির ২ দশমকি ৯০ শতাংশ শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বর্তমান বাজারদরে বিদেশিদের বিক্রি করা শেয়ারের মূল্য ৯২ লাখ টাকা।
দেশের শেয়ারবাজারে সর্বোচ্চ দামের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউনিলিভার কনজুমার কেয়ার লিমিটেড। চলতি বছরের পাঁচ মাসে এ কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করে ৩৪ লাখ ৪০ হাজার টাকার ওপরে তুলে নিয়েছেন বিদেশিরা। চলতি বছরের মে মাস শেষে কোম্পানিটির দশমকি ২৯ শতাংশ শেয়ার আছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা গত ডিসেম্বরে ছিল দশমিক ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি বছরের পাঁচ মাসে কোম্পানিটির ১ হাজার ২০৪টি বা দশমিক শূন্য এক শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশিরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে শেয়ারবাজারে বিদেশি পোটফোলিও বিনিয়োগকারীদের বিক্রির একটা চাপ রয়েছে। শুধু বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে না ভারতের শেয়ারবাজার থেকেও শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশিরা। মূলত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেছেন বলে আমার ধারণা।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, একজন বিনিয়োগকারী যখন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে তখন বাজার থেকে বের হওয়ার জন্য তার একটা পরিকল্পনা থাকে। সে দেশি বিনিয়োগকারী হোক বা বিদেশি বিনিয়োগকারী। লাভ হলে সবাই বিক্রির চেষ্টা করে। শুধু বহুজাতিক কোম্পানি না সার্বিক শেয়ারবাজারেই বিদেশিদের একটা সেল পেশার আছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থির কারণে এ বিক্রির চাপ।-জাগোনিউজ২৪.কম