ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর বাড়োটা। ব্যস্থতম বরিশাল জেলার গৌরনদী ঢাকা বরিশাল মহাসড়ক সংলগ্ম উপজেলার শহরজুড়ে যান্ত্রিক গাড়ির মাঝে হঠাৎ দেখা গেল লাল শেরওয়ানি ও লাল পাগড়ি পরে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে যাচ্ছেন নববধু নিয়ে বর। সেখানে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বর রেজাউল ঘোড়ার গাড়িতে চরে প্রিয়তমাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এ যেন এক অন্যরকম বিয়ের গল্প। এমন রাজসিক বিয়ের ঘটনা ঘটেছে গৌরনদী উপজেলার টরকী বন্দর এলাকায়। হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার এমন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণ করে বিয়ের আয়োজনের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে রবিবার দীর্ঘ পথজুড়েও ছিল হাজারো উৎসুক নারী-পুরুষ ও শিশুর ভিড়। কনের বাড়ি উপজেলার দিয়াশুর থেকে টরকী বাসষ্টান্ড বরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের চিত্রই ছিল এমন। বর রেজাউল ইসলাম তার পিতার ব্যাবসা পরিচালনা করেন। তিনি গৌরনদী পৌরসভা ২নং ওয়ার্ড টরকী এলাকার মোঃ কামাল শাহের ছেলে। পারিবারিকভাবে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন গৌরনদী উপজেলার দিয়াশুর গ্রামের প্রবাসী মোঃ ফরিদ মৃধার মেয়ে কলেজ শিক্ষার্থী তহমিনা আক্তারের সঙ্গে।
বর রেজাউলের শখ পূরণ এবং উভয় পরিবারের সম্মতিক্রমে বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে ব্যতিক্রমী এ বিয়ের আয়োজন করেন তারা। বিয়ে বাড়িতে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে নানা কৌতূহলের ভিড়। কেউ তুলছেন সেলফি আবার কেউ কেউ পরিবার নিয়ে যৌথ ছবি তুলে স্মৃতি অ্যালবামে ধরে রাখতে ব্যস্ত। এ বিয়ের কথা এখন এলাকার প্রায় সব মানুষের মুখে মুখে। রং বেরংয়ে সাজানো ঘোড়ার গাড়িটি শহর প্রদক্ষিন করলে ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ ব্যাপক কৌতুহলের সৃষ্টি করে। এমন বিয়ের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে বর রেজাউল বলেন, ঘোড়ার গাড়ি মূলত গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। আমার জন্মের পর থেকে কখনো বিয়েতে বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার দেখিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই মনের মাঝে একটা শখ জমে ছিল। বিষয়টা বাবা-মার সঙ্গে শেয়ার করি কিন্তু একটা পর্যায় এসে এই আশাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয়। কারণ গৌরনদীতে নেই কোনো ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা। অনেক কষ্টের পরে ব্যবস্থা হয়।
এ সময় তিনি আরো বলেন, বিয়ে এবং অন্য কোন উৎসবে এই ধরনের গাড়ি ব্যবহার হত এই ধরনের গাড়ী ছাড়া সামাজিক অনুষ্ঠান চিন্তায় করা যেত না। কিন্তু আধুনিকতার এই যুগে হারিয়ে যাচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি। তরুণ প্রজন্ম বিয়েতে এই ঘোড়ার গাড়ি ও পালকি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখুক। এতে করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে।
এ বিষয়ে বর রেজাউলের মা রজিনা বেগম বলেন, ছেলে ছোটবেলা থেকে গল্প শুনছে পালকিতে বউ নেওয়া হতো এবং বর ঘোড়ার গাড়িতে করে চড়ে আসত। তখন থেকে শখ ছিল তার বিয়েতে ঘোড়ার গাড়ি ও পালকির ব্যবহার হবে। ছেলে বিয়েতে এমনটাই আবদার করেছে, আমরাও তার আবদার রাখার চেষ্টা করেছি। বিয়েতে আসা আনন্দ টেলিভিশনের বরিশাল ব্যুরো প্রধান কাজী আল আমিন বলেন, আমরা এক সময়ে দেখেছি বিয়ে হলে ঘোড়ার গাড়ি ও পালকির ব্যবহার হতো। ধীরে ধীরে এটা হারিয়ে গেছে। এই সময়ে এ ধরনের একটা উদ্যোগ যেন ঐতিহ্যকে পুনরায় জীবিত করা, এটা একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান বেহারার মো. আমজাদ উদ্দিন বলেন, ঘোড়ার গাড়ি দেশের পুরাতন ঐতিহ্য, এক সময় বিয়েতে ঘোড়ান গাড়ি ও পালকি ব্যবহার হতো এখন আর হয় না। এখন মাইক্রো, রিকশা ও গাড়িতে বিয়ের যাতায়াতের কাজে ব্যবহার হয়। আগে আমরা এই ঘোড়ার গাড়িতে করে বউ আনতাম-নিতাম, এহন আর বিয়াতে কেউ ঘোড়ার গাড়ি নেয় না। আইজগা বিয়া উপলক্ষে হেরা এই ঘোড়ার গাড়ি নিছে আমাগোর তোন খুব ভালো লাগছে। রেজাউল ও তহমিনা তাদের দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয় তার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।