দোয়া আরবি শব্দ, অর্থ- চাওয়া, প্রার্থনা করা, মিনতি করা, অনুরোধ করা, ডাকা, আহ্বান করা ইত্যাদি। এ দোয়া কখনো করা হয় নিজের জন্য, কখনো করা হয় অন্যের জন্য। অন্যের জন্য দোয়া কখনো হয় তার কল্যাণ, উন্নতি, অগ্রগতি, সুখ-শান্তি ইত্যাদি কামনা, তা হলো নেকদোয়া। আবার কখনো হয় অন্যের ক্ষতি, ধ্বংস, দুঃখ-কষ্ট, বিপদাপদ ইত্যাদি কামনা। তা হলো বদদোয়া। মানুষ এমনিতেই কারো জন্য নেক দোয়া বা বদদোয়া করে না; বরং কারো কথা, কাজ, আচার-ব্যবহার, জুলুম-নির্যাতন ইত্যাদিতে অসন্তুষ্ট হয়ে ও কষ্ট পেয়ে তার জন্য বদদোয়া করে। আবার কারো কথা, কাজ আচার-ব্যবহার ইত্যাদিতে সন্তুষ্ট হয়ে তার জন্য নেকদোয়া করে থাকে। নেকদোয়া হলো আশীর্বাদ আর বদদোয়া হলো অভিশাপ। নেকদোয়া ও বদদোয়া ব্যক্তির কর্মের ফল। নেকদোয়া মানুষকে উন্নতি, অগ্রগতি ও মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছায়। আর বদদোয়া মানুষকে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুতরাং মানুষের উচিত বদদোয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করা এবং নেকদোয়া প্রাপ্তির পথ সুগম করা।
রাসূলুল্লøাহ সা:-এর নেকদোয়া: হজরত আবু হুরায়রা রা: একজন প্রসিদ্ধ সাহাবি ও সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। তিনি বলেন, আমি একদা রাসূলুল্লাহ সা:-এর খিদমতে আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছ থেকে যা কিছু শ্রবণ করি এর সব কিছু স্মরণ রাখতে পারি না। তখন রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে বললেন, তোমার চাদরখানা প্রসারিত করো। অতঃপর আমি প্রসারিত করি। তিনি তাতে ফুঁ দেন ও আমার জন্য দোয়া করেন। তারপর তিনি বহু হাদিস বর্ণনা করেছেন। আমি তাঁর থেকে যা কিছু শুনেছি তা ভুলিনি।
হজরত আনাস রা: একজন বিশিষ্ট সাহাবি তিনি মহানবী সা:-এর ১০ বছর খিদমত করেছেন। তার আম্মা উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান একদা মহানবী সা:-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! আপনি আমার ছেলে আনাসের জন্য দোয়া করুন। রাসূলুল্লøাহ সা: তার জন্য দোয়া করেন, হে আল্লøাহ! তাঁর ধন-সম্পদ ও সন্তানে বরকত দান করুন, তাকে দীর্ঘ হায়াত দান করুন এবং তার পাপরাশি ক্ষমা করুন। মহানবী সা:-এর দোয়ার ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে অনেক ধনসম্পদ ও ৭৮ জন মতান্তরে ১২০ জন সন্তান দান করেছিলেন। তার মধ্যে দু’জন কন্যা সন্তান অবশিষ্ট সব পুত্র সন্তান। তিনি ১০৩ মতান্তরে ৯৯ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: মহানবী সা:-এর চাচাত ভাই। তার উপাধি মুফাস্সির সম্রাট। মহানবী সা: তার জন্য হিকমত, দ্বীনি জ্ঞান ও কুরআন মাজিদের ব্যাখ্যার জ্ঞান দানের জন্য দোয়া করেন। হে আল্লøাহ তায়ালা! আপনি তাকে দ্বীনি ও তাফসির শাস্ত্রের অগাধ জ্ঞান দান করুন। মহানবী সা:-এর দোয়ার বরকতে অল্প বয়সেই তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন এবং কুরআন মাজিদের ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব-তথ্য সবচেয়ে বেশি বুঝতেন। তার জ্ঞানের কারণে হজরত উমর রা: তাকে অল্প বয়সে মজলিসে শূরার সদস্য করেন।
তায়েফবাসী মহানবী সা:-কে পাথর মেরে আহত করলে তিনি তাদের জন্য বদদোয়া না করে বরং নেকদোয়া করেন। হে আল্লাহ! আমার কাওমকে হেদায়াত দান করুন। তারা বুঝে না, আমি যে নবী তারা চিনে না। মহানবী সা:-এর দোয়ায় তায়েফ এখন সৌদি আরবের মধ্যে সবচেয়ে সবুজ-শ্যামল এলাকা। সাহাবায়ে কেরাম সাকিফ গোত্রের জন্য বদদোয়া করার অনুরোধ করলে তিনি উল্টা নেকদোয়া করেন। হে আল্লাহ! সাকিফ গোত্রকে হেদায়াত দান করুন। পরবর্তীতে তাদের অনেকে দেহায়াতপ্রাপ্ত হয়েছিল (মিশকাত, হাদিস নং-৫৯৯৫)। তদ্রƒপ দাউস গোত্রের জন্য বদদোয়া করতে বলা হলে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, হে আল্লøাহ! দাউস গোত্রকে হেদায়াত দান করুন এবং হিজরত করার তাওফিক দান করুন (সহিহ বুখারি, মুসলিম, মিশকাত, হাদিস নং-৬০০৫)। মহানবী সা: একদা দোয়া করেন, আল্লøাহুম্মা আয়্যিদিল ইসলামা বি আহাদিল উমাইরাইন- হে আল্লøাহ! ওমর ইবনুল খাত্তাব ও আমর ইবনে হিশাম উভয়ের মধ্যে যেকোনো একজন দিয়ে ইসলামকে শক্তিশালী করুন। আল্লাহ তায়ালা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাবের পক্ষে দোয়া কবুল করেন।
বদর যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে মহানবী সা: দোয়া করেছিলেন, হে আল্লøাহ! আপনি আমার সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা পূরণ করুন। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার প্রতিশ্রুত সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। যুদ্ধ শুরুর পর দোয়া করেন। হে আল্লøাহ, যদি আজ মুসলমানদের এই দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীতে ইবাদত করার মতো কেউ থাকবে না। হে আল্লøাহ তায়ালা, আপনি কি চান, আজকের পর কখনোই আপনার ইবাদত করা না হোক? হজরত আবু বকর সিদ্দিক তখন বলেন, যথেষ্ট হয়েছে, হে আল্লøাহর রাসূল। এবার থামুন (আর রাহিকুল মাখতুম)।
রাসূলুল্লøাহ সা:-এর বদদোয়া: মহানবী সা: হলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন। বদদোয়া করা তার শানের খেলাফ। তারপরও কাফির-মুশরিকদের থেকে কষ্ট পেয়ে তিনি বদদোয়া করতে বাধ্য হয়েছেন।
ইরানের বাদশাহ পারভেজ কর্তৃক ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত মহানবী সা:-এর প্রেরিত পত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার খবর শুনে তিনি তার বিরুদ্ধে বদদোয়া করেছিলেন। হে আল্লøাহ! আমার পত্রকে যেভাবে টুকরো টুকরো করেছে তার রাজ্যকেও সেভাবে টুকরো টুকরো করে দিন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করেছিলেন। তার পুত্র তাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে (মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং-১৫৬৯৩)। বনু সুলাইমের ৭০ জন লোকের একটি দলকে কুরআন মাজিদ শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে বনু তামিমের কাছে প্রেরণ করেন। তারা সেখানে পৌঁছলে প্রতারণার মাধ্যমে রেল ও জাকওয়ান গোত্র ৭০ জন সাহাবিকে নির্মমভাবে শহীদ করে। মহানবী সা:-এ সংবাদ শুনে এক মাস কুনুতে নাজেলা পাঠ করে তাদের জন্য বদদোয়া করেছেন (বুখারি, হাদিস নং-২৮০১)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত, একদা মহানবী কাবাঘরের পাশে নামাজ আদায় করছিলেন। তখন ওকবা ইবনে আবু মুঈত উটের নাড়িভুঁড়ি এনে মহানবী সা:-এর উভয় কাঁধের দু’দিকে ঝুলিয়ে দেয়। রাসূল সা: নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। খবর পেয়ে হজরত ফাতিমা দৌড়ে এসে পিঠ থেকে তা সরিয়ে ফেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা: তিনবার বলেছিল- আল্লøাহুম্মা আলাইকা বি-কুরাইশ- হে আল্লাহ! কুরাইশদের দায়িত্ব আপনার ওপর। পরবর্তীতে নাম ধরে বদদোয়া করেন। হে আল্লøাহ! আবু জেহেলকে পাকড়াও করুন। ওতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওলিদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ এবং ওকবা ইবনে আবু মুইতকে পাকড়াও করুন। তারা সবাই বদরযুদ্ধে নির্মমভাবে নিহত হয় (বুখারি প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-৫৪৩)। নবুওয়াত লাভের আগে মহানবী সা: তাঁর দুই কন্যাকে আবু লাহাবের দুই ছেলের উতবা ও উতাইবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। নবুওয়াতের পরে আবু লাহাব তার ছেলেদেরকে বলে, তোমরা মুহাম্মদ সা:-এর কন্যাদের তালাক দিয়ে দাও। অতঃপর তারা তালাক দিয়ে দেয়। উতাইবা জাহেলিয়াতের মধ্যে খুব বেশি অগ্রসর হয়ে যায়। সে একদিন রাসূলুল্লাহ সা:-এর সামনে এসে বলে আমি ‘ওয়ান নাজমে ইযাহওয়া, আল্লাযি দানা ফা তাদাল্লøা’- অস্বীকার করছি। এ কথা বলে সে মহানবী সা:-এর দিকে থুথু নিক্ষেপ করে। থুথু তাঁর গায়ে লাগেনি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা: তার জন্য বদদোয়া করে বলেন, হে আল্লøাহ! আপনার কুকুরদের মধ্য থেকে একটি কুকুর তার ওপর লেলিয়ে দিন। এরপর উতাইবা তার পিতার সাথে সিরিয়া সফরে যায়।
সফরকালে রাতে কাফেলা এক জায়গায় অবস্থান করে। স্থানীয় লোকেরা জানায়, এখানে রাতে হিংস্র্র জন্তুর আনাগোনা হয়। আবু লাহাব তার কুরাইশি সাথীদের বলে, আমার ছেলের হিফাজতের ভালো ব্যবস্থা করো। কারণ আমি মুহাম্মদ সা:-এর বদদোয়ার ভয় করি। কাফেলার লোকেরা উতাইবার চারপাশে নিজেদের উটগুলোকে বসিয়ে দেয় এবং তারা নিজেরা ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে একটি বাঘ আসে। উটদের বেষ্টনী ভেদ করে সে উতাইবাকে ধরে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলে (আল ইসবালি ইবনে হাজার, দালায়েলুন নবুওয়াতলি আবি নাঈম আল ইসফাহানি, রাওদুল উনুফলিস সুহাইলি)। হে আল্লাহ! আমাদেরকে মানুষের বদদোয়া থেকে বাঁচার এবং নেকদোয়া পাওয়ার মতো কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী