শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
ধনবাড়ীতে আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্ত যুদ্ধ দিবস পালিত মাধবদীতে জ্যান্ত কই মাছ গলায় ঢুকে কৃষকের মৃত্যু বদলগাছীতে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী কালীগঞ্জে কৃষক মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা লতিফ মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে মানববন্ধন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শ্রীনগর গ্রামে ভ্যানচালককে পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন বরিশালে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী মেলার উদ্বোধন হাতিয়ায় দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার ক্যাম্পাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত স্মৃতি কর্ণার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন গজারিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আমিরুল ইসলামের পক্ষে ছাত্রলীগের গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ

স্বাবলম্বী স্বাধীনতা, স্বাধীনতার স্বাবলম্বন

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সত্তর দশকের মাঝামাঝি, স্বাধীনতার পাঁচ কী ছয় বছর পর, তার জীবদ্দশাতেই প্রকাশিত হয়েছিল আবুল মনসুর আহমদের (১৮৯৮-১৯৭৯) প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা স্বাধীনতা’। সময়ের প্রেক্ষাপটে নানান অবয়ব অবকাঠামোয় কষ্টার্জিত স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষায় আর্থসামাজিক রাজনৈতিক নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দীর্ঘ দিনের আন্দোলন, সংগ্রাম ও চূড়ান্ত পর্যায়ে ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধে রক্তক্ষয়ী শত সহস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়। কঠিন দামে কেনা সেই স্বাধীনতা সংহত করতে, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রান্তরে স্বাভাবিক বাধাবিপত্তি, সংশয়, ষড়যন্ত্র সন্দেহে আবুল মনসুর আহমদ বিস্ময় বোধ করছিলেন, বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও ক্ষুরধার লেখনীর আধিকারিক সমকালীন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা কলামে তার অভিমত ও পরামর্শ রেখেছিলেন। সেই লেখাগুলোর সঙ্কলন এই গ্রন্থ। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে সক্ষম হয়ে উঠছে। আর দশটা উদীয়মান অর্থনীতির মতো বাংলাদেশেরও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের, স্বনির্ভর-স্বয়ম্ভর হতে নিরন্তর সংগ্রামে থাকতে হচ্ছে। কেননা সামাজিক, মানব উন্নয়ন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সবল ও সর্বোপরি অর্থনৈতিক সমস্যা সামলানোর সক্ষমতা অর্জন ব্যতিরেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থবহ, নিরাপদ ও টেকসই উন্নয়নাভিমুখী করা যায় না। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ, গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ গঠন, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, জানমালের নিরাপত্তা বিধান, ধর্ম পালন, নিজস্ব সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-বিশ্বাসের অবারিত চর্চা নিশ্চিত করা ইত্যাদি সাধারণ জাতীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিটি জাতির জন্য অপরিহার্য। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয় এবং বিশ্বমানচিত্রে অস্তিত্বময় হয় বাংলাদেশ। বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্জন একেবারে কম না হলেও যতটা হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ ছিল, ততটা অর্জিত না হলেও তা অর্জনে চেষ্টার কমতি নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে আমাদের রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ, সুশাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সক্রিয় ছিল। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়েছে, বাস্তবতার আলোকে তা বলার সময় এখনো যেন এসেও আসেনি। বৈষম্যবিহীন আচরণ, দলমত বিশ্বাস নির্বিশেষে সবার প্রতি সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা, সবার জন্য আইনের সমপ্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ফুরিয়ে যায়নি। সন্ত্রাস, সঙ্ঘাত-সহিংসতার পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সময় নিতে বা দিতে হচ্ছে। রাজনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সেবাধর্মী মনোভাব মনোভঙ্গির সংস্কার অব্যাহত আছে বা থাকতেই হবে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য বেশি প্রয়োজন সংগ্রাম ও শক্তির। প্রয়োজন প্রযুক্তি, কৌশল, ঐক্য ও ন্যায়বোধ। স্বাধীনতাকে নির্মল করতে জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা ও সৎ বিবেচনা কাজে লাগানো একান্ত অপরিহার্য। মূলত যথেষ্ট সচেতন ও সঙ্ঘবদ্ধ না হলে স্বাধীনতা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে না। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হয় ও সদা সতর্ক থাকতে হয়।
বাংলাদেশের জনগণ এমন একটি রাষ্ট্রকাঠামো পেতে চেয়েছিল, যা কতগুলো সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও মূল্যবোধকে ধারণ করবে। নাগরিকদের মধ্যে সেগুলো নির্বিঘœ চর্চার পরিসর তৈরি করবে। প্রাক্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে যেসব আদর্শ ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না বলেই সে রাষ্ট্র টেকেনি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জনগোষ্ঠী তার ইতিহাসে একটি অনন্য ও অভিনব বাস্তবতা তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য এক দিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে অভিষিক্ত করে, অন্য দিকে নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল হিসেবে পাওয়া সেসব আদর্শ ও মূল্যবোধ চর্চার এক কঠোর দায় আরোপ করে এবং অবারিত সম্ভাবনার সুযোগ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ তাই একাধারে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের সমাপ্তি এবং আরেকটি দীর্ঘ লড়াইয়ের সূচনা।
প্রথমত মুক্তি। মুক্তি মানে মানুষের সার্বিক বিকাশের মুক্তি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোতে নবতর আকাক্সক্ষা ও অভাবের জীবনে বেশির ভাগ মানুষ হয়ে ওঠে এমন নুড়িপাথর, যার কাছে শ্যাওলা ও শেকড়ের গন্ধময় হারানো জীবনটি বর্জ্য বৈ কিছুই নয়। লোভ ও ভোগের আবর্তে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার অনুসন্ধানের স্পৃহা, নিজের অজান্তে সে হয়ে ওঠে ক্ষমতাবানদের ক্রীড়নক ও ভোগবাদী সমাজের পণ্য। যে আত্মজিজ্ঞাসা আদিম দর্শনের উদ্ভব ঘটিয়ে থাকে তা হয়ে ওঠে দূর চিন্তার বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর সব হারিয়ে মানুষগুলো একাকী বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ববাদী চিন্তায় যেমন মগ্ন হয়েছিল, তেমন চিন্তায় আধা সামন্তবাদী এ দেশের মানুষ আবিষ্ট না হলেও জীবনের প্রয়োজনে, স্বার্থের অনুপ্রেরণায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে ওঠে। বিবাদের সময় যেসব মানুষ ইতিবাচক চিন্তা ও বিশ্বাসের মধ্যে মুক্তি খুঁজেছিল, তাদের কেউ কেউ বিকৃত ও অসুস্থ চিন্তা এবং ততোধিক বিকৃত নাস্তিক চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে। সর্বোপরি প্রাধান্য পায় স্বার্থচিন্তা ও ভোগবাদ। বেশির ভাগ মানুষ ভোগবাদী সমাজের ক্রীড়নক ও খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। অদূরদর্শী চিন্তার কারণে গভীর চিন্তাগুলো ও আত্মার মৌলিক জিজ্ঞাসাগুলো গৌণ হয়ে ওঠে।
বাঙালিত্ব। দেশভাগের আগ পর্যন্ত নানা কূট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ‘বাঙালি’ ধারণার সাথে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের যোগসূত্র স্থাপিত হতে পারেনি। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর পূর্ববাংলার সেই জনগোষ্ঠীই তার রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বাঙালিত্বের ধারণাটিকে আত্মপরিচয়ের কেন্দ্র করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। রক্ত দিয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলা ভাষার দাবি। ষাটের দশকজুড়ে রাজনীতির পাশাপাশি যেসব সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চলে, তাতে অনেক কঠিন পথে বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে বাঙালিত্বের সেই জাতিগত স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা সম্পূর্ণতা পায়। কিন্তু স্বাধীন দেশের মাটিতে বিভিন্ন ধর্মীয় ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার উপাদানের সাথে এই ধারণার স্বাস্থ্যকর সমীকরণ হতে সময় লেগেছে। এ নিয়ে আরো কিছুটা পথ যেতে বাকি। এরপর গণতন্ত্র। পাকিস্তানের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে আমাদের সব সংগ্রামের পেছনে ছিল মূলত গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার তৃষ্ণা। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাতে এসেছিল সেই ঘোষণা। বিশেষ করে উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা। নির্বাচনে ভূমিধস জয় পাওয়া সত্ত্বেও নানা ছলে আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনার প্রাপ্য গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। সেই গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে হলো। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এই নির্বাচনী বিজয়ই দিয়েছিল এক অনন্য নৈতিক ভিত্তি। এবার অসাম্প্রদায়িকতা। উপমহাদেশ ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্মরাজনীতিতে সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত ইসলাম। পাকিস্তান রাষ্ট্রধারণার সে ব্যবহারের বিপরীতে ধর্মীয় সীমারেখার বাইরে পূর্ববাংলায় ভাষানির্ভর একটি অসাম্প্রদায়িক জনঐক্য গড়ে ওঠে। ষাটের দশকের ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলন অসাম্প্রদায়িকতাকে সে চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। তবে স্বাধীনতার পর অসাম্প্রদায়িকতার বচন বহুধায় বাহুল্যতায় সনাতন ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যবলয়কেই বিতর্কিত করে তোলে। অসাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শেই অনুপ্রবেশ ঘটে সাম্প্রদায়িক আচার আচরণ। বৃহত্তর চাওয়ার মধ্যে যে ক্ষুদ্র চাওয়া ও সঙ্কীর্ণ চিন্তাগুলো চাপা পড়েছিল সেটিই স্বাধীনতার পর মুখ্য হয়ে ওঠে। এতে গৌণ হয়ে ওঠে সার্বজনীন স্বাধীনতা ও ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা। শক্তি ও ঔদ্ধত্যের কাছে পরাভূত হয় মানুষের অধিকার ও মর্যাদা; গৌণ হয়ে ওঠে শান্তির অন্বেষণ। যে আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে দর্শনের চিন্তাগুলো আবর্তিত হয় তা ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কারণে গঠনমূলক দর্শন তৈরি অসম্ভব হয়ে ওঠে। এটি ঠিক, শূন্যতার মধ্যে, নাস্তির মধ্যে দর্শনের বিকাশ ঘটতে পারে, যেটি হয়েছিল ইউরোপে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সেটি না হয়ে স্বাধীনতা-উত্তর সমাজে শূন্যতা, হতাশা, নৈরাজ্য ও ক্ষমতার ঔদ্ধত্য বা সঙ্ঘাত-সহিংসতার নেতিবাচক দর্শনের চর্চা শুরু হয়। পশ্চাৎপদ চিন্তা ও মনের শূন্যতা মৌলবাদী কর্মপ্রক্রিয়ার পথ সুগম করে দেয়। বিচারের প্রতি, জীবনের প্রতি ও সামগ্রিক জীবনের ইতিবাচক প্রবাহের প্রতি আস্থা ফেরানোর চেষ্টা চালাতে হচ্ছে। বৈষম্যবিলোপ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মধ্যে নানা বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। এই দুই অংশে খুব স্পষ্টভাবে দুই বিপরীতমুখী অর্থনৈতিক কর্মসূচি অনুসরণ করা হয়। রফতানিতে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও দেশের পূর্ব অংশে বিনিয়োগ হয় কম। বড় ও ভারী শিল্পকারখানা প্রায় সবই গড়ে তোলা হয় পশ্চিম অংশে। পূর্ব অংশের ব্যবসায়-বাণিজ্য থেকে শুরু করে অর্থনীতির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে পশ্চিমের অল্প কয়েকটি ধনাঢ্য পরিবার। সরকারি চাকরি ও সামরিক বাহিনীতে দেখা দেয় কোটার ব্যাপক বৈষম্য। এ পরিস্থিতির প্রকাশ ঘটে দুই অর্থনীতির তত্ত্বে। বাঙালিদের স্বপ্নভঙ্গের রাজনৈতিক প্রতিফলন দেখা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের দেয়া ছয় দফায়।
ছাত্রদের ১১ দফা দাবিতে এই বৈষম্য ঘোচানোর দাবি আরো স্পষ্ট রূপ পেলেও স্বাধীনতার দাবির সাথে মিলেমিশে যায় বৈষম্যবিলোপের আকাঙ্ক্ষা। পাঁচ দশক পরে এসে দেখা যাচ্ছে, সমাজের সর্বত্র বৈষম্য বেড়েছে ব্যাপকভাবে। স্ব-উদ্ভাবিত লুটেরা অর্থনীতি যেন বদলে দিচ্ছে সমাজচিন্তা ও রাষ্ট্রের দর্শন।
যাপিত জীবন, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয়, জীবনের নানা আকাঙ্ক্ষাসহ সাধারণের অর্থবিত্ত ও সম্পদের যে কাঠামো মানুষের দর্শন ও মূল্যবোধ নির্মাণ করে, সেই স্থানটি ক্রমেই স্খলনের মুখে। প্রতিটি যুদ্ধই মানুষের স্মৃতি, অনুভব ও বোধকে এমনভাবে নাড়া দেয় যাতে তার চিন্তার উপাদান ও অলিগলি সবই বদলে যায়। এ কারণে কখনো সে শতবর্ষ এগিয়ে যায় বোধের ভূমিতে, আবার কখনো পিছিয়ে যায় হাজারো বছর। যুদ্ধের ধ্বংস, আঘাত ও চাপিয়ে দেয়া অনিকেত জীবন মুছে ফেলে মানুষের চিন্তার ভূমি; কখনো হারিয়ে যায় কয়েকটি প্রজন্ম।
সব শেষে মানবাধিকার : ১৯৭১ সাল পর্যন্ত গড়িয়ে আসা লড়াই ও মুক্তিযুদ্ধের পুরোটাই এক অর্থে মানবাধিকার অর্জনের সংগ্রাম যার রাজনৈতিক আদর্শ এবং সাংস্কৃতিক সত্তা চর্চার অধিকার, ধর্মপালনের অধিকার, মত পোষণ ও প্রকাশের অধিকার। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান আগাগোড়াই এর বিরোধী ছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধে ঘটে এর হিংস্রতম প্রকাশ। পুরো ৯ মাস ধরে অত্যন্ত প্রকটভাবে মানবাধিকার পদদলিত করা হয়। আর্চার ব্লাডের ভাষায়- যুদ্ধের সময় তারা চালিয়েছিল ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শ লালনের জন্য।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে দেশে মানবাধিকারের আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষা এখনো আকাঙ্ক্ষা ও দাবির পর্যায়ে রয়ে গেছে বলে মনে হবে। মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সর্বোপরি মুক্তির স্পৃহা যা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জনমনে সংহতি নির্মাণ করেছিল, যে গুণাবলি দেশের জন্য শীর্ষ ত্যাগে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তার অনেকটাই স্লান হয়ে যায় স্বাধীনতার পরপর। এর একটি বড় কারণ হলো- যুদ্ধের সময় যে জনগণ অর্থবিত্তের সাথে সম্পর্কহীন ও শেকড়বিহীন অবস্থায় মনোজাগতিক ভূমিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিল, স্বাধীনতার পরপর তারা ভৌগোলিক ভূমি ও অর্থবিত্তকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়। এতে যে মঙ্গলময় চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা আপন আত্মার ক্ষুদ্র বলয়কে ছিন্ন করে ব্যক্তিকে সর্বজনীন আবর্তে নিয়ে গিয়েছিল তা স্বাধীনতার পরপর যেমন ছিন্নপত্রের মতো ভেসে যায়, তেমনি বাস্তবতার চাপে স্বার্থান্ধ চিন্তার আবর্তে ব্যক্তির শুদ্ধ অবস্থান ও মূল্যবোধ গভীর অতলে হারিয়ে যায়।
যে প্রেম ও মানবতা নানামুখী ভেদজ্ঞানকে নি¤œপর্যায়ে এনে বেদনার বাঁধন মানবসত্তাকে সমুজ্জ্বল করেছিল, সেই প্রত্যক্ষ বেদনা নি¤œস্তরে নেমে আসায় বহিরাগত শত্রু অলক্ষ্য ছায়ামানুষ হয়ে ওঠে আর আপন মানুষগুলোই স্বার্থের টানাপড়েনে নতুন শত্রু হয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে যে নষ্ট চিন্তা, মৌলবাদী দর্শন ও পশ্চাৎপদ চিন্তা অন্তরে ধারণ করে শত্রুপক্ষ বাঙালি নিধনে মত্ত হয়েছিল, গণহত্যার মতো নিকৃষ্ট কাজে ব্যাপৃত হয়েছিল, সেই দর্শন ও ঘাতকের বাণীকেই অনেকে আপন করে নেয়। যে নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় ঘাতক নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল, যে পৈশাচিক বিকারগ্রস্ত চিন্তাকে আপন করে নিয়ে বাঙালি নিধনকর্মকে সহজ করে নিয়েছিল, ওই কর্ম ও চিন্তাকে জনগণের একটি অংশ মনোজগতে আপন করে নিয়ে নিজ অস্তিত্ব ভাবনার সাথে সম্পৃক্ত করে নেয়। স্বাধীনতা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পথে তা যেন ক্রমেই বাধার বিন্ধ্যাচল না হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে সচেতন থাকার আবশ্যকতা ফুরিয়ে যায়নি। ইমেল :mazid.muhammad@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com