নদীমাতৃক এই দেশে নদীভাঙন স্বাভাবিক বিষয়। তবে নদীভাঙন ঠেকানোর এক মোক্ষম অস্ত্র ‘জিও ব্যাগ’। নদীপাড়ের অতি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নদীবিষয়ক মন্ত্রী আমলা পর্যন্ত— সবারই মুখস্থ এই ‘জিও ব্যাগ’র নাম। জিও-এবড় একটি গ্রিক শব্দ। যার অর্থ পৃথিবী, মাটি, জমিন। দেশের নদ-নদীর ‘শাসক’ পাউবো; মানে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর তাদের ‘সিপাহী-পেয়াদা’ অর্থাৎ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের কাছে দারুণ প্রিয় জিনিস এই ‘জিও ব্যাগ’।
নদী ভাঙছে? কোনও কথা নেই, ডাকো টেন্ডার ফেলো ‘জিও ব্যাগ’। ব্যাস, শুরু হয়ে যায় নদীভাঙন ঠেকানোর নামে মহাযজ্ঞ। আর সেইসঙ্গে শুরু হয় আরেক যজ্ঞ— ‘জনগণের টাকা লোপাটের মচ্ছব’। এই কথাও কমবেশি সবারই জানা। অদৃশ্য থাকে শুধু লুটপাটের দলিল-প্রমাণ। কারণ, পানির কাজ পানিতেই ভেসে যায়। গুনে দেখার উপায় থাকে না— কতটা ‘জিও ব্যাগ’ ফেলানোর কথা, ফেলা হলো কয়টা। আর কতটি ‘চুরির’ কারণে জনগণের সর্বনাশই বা হলো কতটুকু! বছরের পর বছর চোখের সামনে এমন ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ-অভিযোগের প্রেক্ষিতে মানিকগঞ্জে পদ্মার ভাঙন রোধের নামে ‘নদী চুরি’র প্রমাণ বের করতে অনুসন্ধানে নামে একটি নিউজ পোর্টাল। অনেক কৌশলে একসময় বের করে আনা হয় পদ্মাপাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় পাউবোর ভাঙন রোধ প্রকল্পে ‘জিও ব্যাগ’ চুরির উৎসব। পাউবোর অসাধু কর্মকর্তা আর ঠিকাদাররা যোগসাজশ করে তাদের নিয়োজিত শ্রমিক সর্দারদের দিয়ে কীভাবে বছরের পর বছর চালিয়ে আসছে এই ‘চুরি’— সেই গল্পই উঠে এসেছে দুই মাসের অনুসন্ধানে। এবারের বর্ষায় নদী ভাঙনে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লী ইউনিয়নের আয়নাপুর গ্রামের দরিদ্র বিনি বেগমের ২০ শতাংশ জমি চলে গেছে নদীর পেটে। তিন বছর আগে এ এলাকায় মানিকগঞ্জ পাউবো ভাঙন ঠেকাতে ‘জিও ব্যাগ’ ফেলে জরুরি প্রতিরক্ষা কাজ করেছিল। ওই বছর ভাঙন ঠেকাতে পারলেও পরের বছরগুলোতে আর পারেনি। চলতি বছর ভাঙন ঠেকাতে আবারও আয়নাপুর এলাকায় ধলেশ্বরী নদীতে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০ মিটার এলাকায় জরুরি প্রতিরক্ষা প্রকল্পের কাজ করে পাউবো। তবে এ প্রকল্প নেওয়ার পরও বিনি বেগমের জমি বাঁচানো যায়নি। তার মতো ওই এলাকার ডজনখানেক পরিবারের জমি চলে গেছে নদীর পেটে। অনেকে জমিজমা বসতভিটা হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন খাস জমি, আত্মীয়-স্বজন বা অন্যের বাড়িতে।
মানিকগঞ্জ পাউবো থেকে জানা যায়, চলতি বছর সাটুরিয়া উপজেলার আয়নাপুরে ধলেশ্বরী নদীতে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০ মিটার এলাকায় ১২ হাজার ‘জিও ব্যাগ’ ফেলার প্রকল্প নেওয়া হয়। এ ছাড়াও ধলেশ্বরী নদীর বরাইদ ১৫০ মিটার এলাকায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮ হাজার, ধলেশ্বরী নদীর আব্দুর রহমান খান উচ্চ বিদ্যালয় ৪০০ মিটার এলাকায় ৯০ লাখ টাকার ২২ হাজার, ধলেশ্বরী নদীর রাইল্যা ২০০ মিটার এলাকায় ২০ লাখ টাকার সাড়ে ৫ হাজার, ধলেশ্বরী নদীর হরগজ ১০০ মিটার এলাকায় ২৮ লাখ টাকার ৬ হাজার, ধলেশ্বরী নদীর তিল্লী ও চর তিল্লী ২০০ মিটার এলাকায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২ হাজার ‘জিও ব্যাগ’ ফেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে মানিকগঞ্জ পাউবো।
পরিচয় গোপন রেখে এসব প্রকল্পের শ্রমিক সর্দার পাবনার সবুজের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় গত ২৭ আগস্ট। ‘আমি পাউবোর একজন নতুন ঠিকাদার; জিও ব্যাগ ফেলার কিছু কাজ পেয়েছি; তেমন কিছু বুঝি না, আপনার সহযোগিতা চাই’- ইত্যাদি কথাবার্তা বলে সবুজকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে সবুজ বলেন, ‘কোনও চিন্তা নাই। চলতি বছরও সাটুরিয়ায় জিও ব্যাগ প্রকল্পগুলোতে আমিই কাজ করছি। কীভাবে লাভ বের করতে হয়, সে ব্যবস্থাও করে দেবো।’ এবার প্রকল্পগুলোতে কোথায় কতটি জিও ব্যাগ ফেলেছেন— জানতে চাইলে সবুজ যে পরিসংখ্যান দেন, তার সঙ্গে মানিকগঞ্জ পাউবোর সরবরাহ করা তথ্য মেলে না। দেখা যায়, প্রতিটি প্রকল্পেই ওয়ার্ক অর্ডারে নির্ধারিত জিও ব্যাগের সংখ্যার চেয়ে কম ফেলা হয়েছে। ‘আমার কাজটাও করে দেন’ বললে তিনি শরীয়তপুর পাউবোর কাজে ব্যস্ত আছেন; তবে প্রাথমিক বৈঠকের জন্য তার ভাইকে পাঠাবেন বলে জানান। পরদিন ২৮ আগস্ট পাবনা থেকে সবুজের ভাই পরিচয়দানকারী জুয়েল নামের একজন আসেন মানিকগঞ্জে। দুপুরের দিকে একটি রেস্টুরেন্টে খেতে বসে আলাপকালে জুয়েল জানান, মানিকগঞ্জে জিও ব্যাগের একাধিক কাজ করেছেন তারা। চলতি বছর সাটুরিয়ার সব কাজ তারাই করেছেন। জুয়েল বলেন, ‘অন্যান্য দপ্তরের ঠিকাদারির চেয়ে পাউবোর ঠিকাদারিতে লাভ বেশি। এসও-কে (সেকশন অফিসার) হাত করা গেলে লাভের পরিমাণ আরও বেশি। কাজের সব হিসাব-কিতাব মূলত তার কাছেই। তবে হঠাৎ নির্বাহী প্রকৌশলী পরিদর্শনে আসেন। সেটাও এসও আগেই আমাদের জানিয়ে দেন। শুধু ওইদিন একটু নিয়ম অনুযায়ী কাজ করার তাগিদ আসে। নির্বাহী প্রকৌশলীও তেমন সমস্যা করেন না। তবে টাস্কফোর্স এলে সমস্যা হয় বলে শুনছি।’ পাউবো থেকে জানা যায়, টেন্ডার-ওয়ার্ক অর্ডার প্রক্রিয়ার পর প্রকল্পের কাজ শুরু হলে পাউবো থেকে একজন সেকশন অফিসারকে (এসও) দায়িত্ব দেওয়া হয় কাজ তদারকির জন্য। তার সঙ্গে থাকেন একজন সহকারী। নির্বাহী প্রকৌশলীও হঠাৎ প্রকল্প পরিদর্শনে যান।
সাটুরিয়ার প্রকল্পগুলোর এসও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মানিকগঞ্জ পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. হেলালুজ্জামান। আয়নাপুর এলাকায় কতগুলো জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে জানতে চাইলে রাইজিংবিডিকে তিনি জানান, ১০ হাজার ব্যাগ ফেলা হয়েছে। ‘কিন্তু ওয়ার্ক অর্ডারে ১২ হাজার জিও ব্যাগ নির্ধারণ করা ছিল’ জানালে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘এ তথ্য আপনাকে কে দিয়েছে?’ ‘এ তথ্য আপনাদের নির্বাহী প্রকৌশলী দিয়েছে’ জানালে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলেন, ‘বিভিন্ন সাইজের জিও ব্যাগ ফেলতে হয়। অনেক সময় খেয়াল থাকে না। অফিসে কাগজপত্র দেখলে বুঝতে পারবো।’
আয়নাপুর প্রকল্পের ঠিকাদার আব্দুল জলিলকে প্রশ্ন করলে তিনি ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন। সাটুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আরা বলেন, পাউবোর জরুরি জিও ব্যাগ প্রকল্পে আমাদের একজন প্রতিনিধি থাকেন। অফিসিয়াল কাজসহ একাধিক প্রকল্পে ব্যস্ত থাকায় তার পক্ষেও সব বিষয়ে নজরদারি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যদি কেউ লিখিত অভিযোগ করে, তখন আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’ চলতি বছর পদ্মার ভাঙন ঠেকাতে হরিরামপুর উপজেলার গোপীনাথপুর ৩৫০ মিটার এলাকায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৩ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার কাজ করা হয়েছে। একই উপজেলার কা নপুর ৭৫০ মিটার এলাকায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫০টি জিও টিউব ও ৭০ হাজার জিও ব্যাগ, ঘিওর উপজেলার পুরাতন ধলেশ্বরী শ্রীধরনগর, নার্সি, রসুলপুর ও পূর্ব ঘিওর ৪০০ মিটার এলাকায় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার ২৫ হাজার জিও ব্যাগ, শিবালয় উপজেলার যমুনা নদীর দক্ষিণ শিবালয় ৪০০ মিটার এলাকায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ২৫০টি জিও টিউব ও ৪ হাজার জিও ব্যাগ প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে এবং একই কায়দায় লুটপাট চলেছে।
গোপীনাথপুর এলাকায় সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন মোতালেব মিয়া। তাকেও ঠিকাদার সেজে এই প্রতিবেদক ‘কাজ পেয়েছেন; তার সহযোগিতা দরকার’ বলে জানালে তিনি পরেরদিনই পাবনা থেকে মানিকগঞ্জ চলে আসেন। তাকে নিয়েও বসা হয় একটি রেস্টুরেন্টে। কথায় কথায় মোতালেবও নিশ্চিত করেন, গোপীনাথনাপুরসহ সব প্রকল্পেই নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে কম জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এর আগেও তারা এ জেলায় একাধিক কাজ করেছেন। সব প্রকল্পেই নির্ধারিত জিও ব্যাগের থেকে কম ফেলেছেন। মোতালেব আরও বলেন, ‘গোপীনাথপুরে আপৎকালীন অস্থায়ী প্রকল্পের বাইরেও সাড়ে ৪০০ মিটার এলাকার একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের কাজ করেছি আমি। ওই প্রকল্পে দুই দফায় ৫৬ হাজার ৫০০ জিও ব্যাগ ফেলানোর কথা ছিল। প্রথম দফায় ২২ হাজার ৭০০টি জিও ব্যাগ ফেলি। তবে এসও’র সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায় কাগজেকলমে ২৫ হাজার ৬০০ ব্যাগ ফেলানোর হিসাব দেখাই। এসব কাজে প্রতিদিনই জিও ব্যাগ ফেলা হয়। প্রতিদিনই কমবেশি কারচুপি করা হয়।’ বলেন, ‘প্রথম দফায় যে ২ হাজার ৯০০ জিও ব্যাগ না ফেলেই হিসাব দেখাই। তা থেকে প্রতি ব্যাগের জন্য একজন এসও’কে (শাহিনুর রহমান নামে একজনের নাম বলেন) ১০০ টাকা করে দিতে হয়েছে।’
সেই হিসাবে এসও’র পকেটে ঢুকেছে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তবে এসব জিও ব্যাগের দাম টেন্ডার শিডিউলে কত টাকা করে ধরা হয়, সেটা জানাতে পারেননি তিনি। পরে পাউবোর কাছ থেকে জানা যায়, দর ধরা ছিল ব্যাগপ্রতি ৪৫৪ টাকা। সাব কন্ট্রাক্টর মোতালেব মিয়ার ভাষ্যমতে, প্রতি ব্যাগ থেকে ১০০ টাকা এসও, আর বাকি ৩৫৪ টাকা ঠিকাদারের পকেটে ঢুকেছে। সেই হিসাবে এই প্রকল্পের প্রথম দফার কাজ থেকেই ২ হাজার ৯০০ জিও ব্যাগ চুরি করে বাড়তি ১০ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ টাকা লুটে নিয়েছে ঠিকাদার পক্ষ। মোতালেব আরও জানান, ‘ব্যাগপ্রতি শ্রমিক খরচ হয় ১০০ টাকা আর ব্যাগ তৈরির খরচ যায় ১৫০ টাকা। তাহলে ৪৫৪ টাকার একেকটি জিও ব্যাগ থেকে ঠিকাদারের লাভ থাকে ২০৪ টাকা। সেই হিসাবে, নদীতে ফেলা ২২ হাজার ৭০০ ব্যাগ থেকে ঠিকাদারের এমনিতেই লাভ হচ্ছে ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ৮০০ টাকা। আবার অভিযোগ আছে, টেন্ডারের সময় নমুনা হিসেবে ঠিকাদার যে বালু দেখিয়েছে, বাস্তবে অনেক সময় সেটা না দিয়ে ওই নদী থেকেই বালু তুলে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেয়। তখন ঠিকাদারের লাভের অংক আরও বেড়ে যায়। তবে ঠিকাদার লাভের সব টাকা পকেটে নিতে পারেন না। এখান থেকে অফিস খরচ, এসও খরচ, এসও’র সহকারীর খরচ বহন করতে হয়।’
মোতালেব আরও অসাধু রাস্তা দেখিয়ে বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে দ্বিতীয় দফার কাজ শুরু হবে। ওয়ার্ক অর্ডারে দুই দফা মিলিয়ে মোট ৫৬ হাজার ৫০০ ব্যাগ ফেলার কথা থাকলেও আমাকে ৪০ হাজারের বেশি ব্যাগ ফেলতে হবে না। তবে এসও কাগজেকলমে ঠিকই সাড়ে ৫৬ হাজারের বিল দেখিয়ে দেবেন।’
তবে মোতালেবের মতে, ‘এসওকে হাত করা না গেলে বা তিনি সৎ হলে তখন লাভ কম হয়। তবে মানিকগঞ্জ পাউবোর কোনও এসও-ই সৎ না। সবাই টাকা খায়। এই সাব কন্ট্রাক্টর কাম শ্রমিক সর্দার বলেন, ‘শুধু আপনাকে সম্পর্ক তৈরি করে নিতে হবে। যদি না পারেন, তাহলে সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে আমার কাছে কাজ দিয়ে দেবেন। আমিই অফিস খরচ, এসও খরচসহ যাবতীয় খরচ মিটিয়ে কাজ শেষ করে দেবো। আমাদের সাথে এসওদের ভালো সম্পর্ক। পানির হিসাব পানিতে চলে যায় বলে এসব প্রকল্পে অনিয়ম সহজে কেউ বের করতে পারে না। আর নদীর কাছাকাছি প্রকল্পগুলোতে বেশি লাভ। জিও ব্যাগ কিনে নদীর বালু দিয়ে ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনও কাজ নেই। ঠিকাদাররা শুধু শ্রমিকের মজুরি আর জিও ব্যাগে খরচ করে থাকেন। অনেকে আবার এতটুকুও করতে না চাইলে আমাদের সাবে কাজ দিয়ে দেন।’
এসব অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাজওয়ার ট্রেড সিস্টেম লিমিটেডের মালিক আব্দুর রাজ্জাকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার আহসান আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠান সারাদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৯টি প্রকল্পের কাজ করছেন। মোতালেব, নুরুজ্জমান, শাহাদতসহ ৪-৫ জন প্রকল্পগুলোয় কাজ করেন। অফিসের কাগজপত্র না দেখে সব বলা যাচ্ছে না। তবে গোপীনাথপুরে টাস্কফোর্স, স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে কাজ করা হয়েছে। ওইখানে অনিয়মের বিষয়টি সত্য নয়।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক ক্ষুদেবার্তা পাঠানোর ঘণ্টাখানেক পরে মুঠোফোনে বলেন, সারাদেশে তাদের একাধিক প্রকল্পের কাজ করতে হয়। সব বিষয়ে খোঁজখবর রাখা সম্ভব হয় না। অনেকেই তাদের কাছ থেকে সাব কন্ট্রাক্টে কাজ নিয়ে থাকেন। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের গোপীনাথপুর এলাকার প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে জানালে তিনি বলেন, ওখানে হয়তো এসওদের সাথে শ্রমিক সর্দারদের মনোমালিন্য হয়েছে; এ কারণে এমন তথ্য পেয়ে থাকতে পারেন। তবে বিষয়টি সত্য নয়। কারণ, টাস্কফোর্সের উপস্থিতিতে কোনও অনিয়ম হওয়ার কথা না। জানতে চাইলে গোপীনাথপুর প্রকল্পে এসও হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পুর.) শাহিনুর রহমান বলেন, ওখানে মোতালেবের সাথে নুরুজ্জামান নামের সর্দারও কাজ করেছে। তাদের মধ্যে হিসাবে গড়মিল থাকতে পারে। তবে আমাদের কোনও হিসাবে ভুল নেই। কারণ এখানে টাস্কফোর্সের সদস্যরা সব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। সব কাজ সুষ্ঠুভাবে করা হয়েছে। এ ছাড়া আমি অন্য প্রকল্পে ব্যস্ত থাকলেও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন ও মো. মনিরুজ্জামান দায়িত্ব পালন করেছেন। টাস্কফোর্সের সাথে সবসময় দুই জন এসও কাজ করেছেন। এখানে একটা ব্যাগও কম ফেলার সুযোগ নই। আমি কা নপুর এলাকায় বেশি ছিলাম।
‘শ্রমিক সর্দার মোতালেব বলেছেন, নদীতে না ফেলা জিও ব্যাগপ্রতি আপনি ১০০ টাকা করে টাকা নিয়েছেন’- এমন অভিযোগ তুললে এসও শাহীন, যেখানে টাস্কফোর্স আছে, সেখানে অনিয়মের সুযোগ নেই। আমি টাকা নিয়েছি কিনা, এর জবাবে কী বলবো, বলেন?’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনগণের দুর্ভোগকে পুঁজি করে এসকল প্রকল্প থেকে লুটপাট করা হয়। যারা এর দেখভাল করবে তারাই এসব অনিয়মের সাথে জড়িত। সঠিক নজরদারি ও জবাবদিহিতার অভাবে জিও ব্যাগ প্রকল্পে অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না। দোষীদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে জিও ব্যাগ প্রকল্পে জনগণের সুফল মিলবে। কিন্তু এসব অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চললেও কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় জনস্বার্থ বিঘিœত হচ্ছে।
সার্বিক অভিযোগের বিষয় তুলে ধরলে মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাঈন উদ্দিন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘গোপীনাথপুরে মূলত দুটি প্রকল্প। এক কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৫০ মিটারের জরুরি প্রতিরক্ষা কাজ করা হয়েছে। ওখানে ৩৩ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। অন্যটি করছে তাজওয়ার ট্রেড সিস্টেম। এ প্রজেক্টে টাস্কফোর্স উপস্থিত ছিল। তাই এখানে অনিয়মের কোনও সুযোগ নেই। সাব কন্ট্রাক্টর মোতালেব অনিয়মের তথ্য দিয়েছেন— জানালে তিনি বলেন, ‘এমন হওয়ার কথা নয়। তবু খোঁজ নিচ্ছি।’ সাব কনট্রাক্টরের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার নিয়ম আছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, যে ঠিকাদার টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে কাজ পেয়েছেন; পানি উন্নয়ন বোর্ড তার কাছ থেকেই কাজ বুঝে নেয়। কোনও সাব ঠিকাদারের সাথে আমাদের কন্ট্রাক্ট হয় না। অভিযোগ উঠা অন্যান্য জরুরি প্রকল্পের বিষয়েও তিনি খোঁজখবর নেবেন বলে জানান।- রাইজিংবিডি.কম