‘বালাগাল উলা বি কামা-লি হি, কাশাফাদ দুজা বি জামা-লি হি; হাছুনাত জামিউ খিছ-লি হি, ছল্লু আলাইহি ওয়া আ-লি হি। ‘পূর্ণতায় যিনি ঊর্ধ্বে সবার; তাঁর রূপের ঝলকে কেটেছে আঁধার, সবকিছুই সুন্দর তাঁর; দরুদ তাঁকে ও তাঁর পরিবার।’ মানবতার কল্যাণ তথা দুনিয়ার শান্তি ও পরকালে মুক্তির পথনির্দেশনার জন্য আল্লাহ তাআলা নবী রাসুলগণকে পাঠিয়েছেন। নবী-রাসুলগণের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি বিশ্বনবী, তাঁকে পাঠানো হয়েছে বিশ্বশান্তির জন্য, বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে নবী!) আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-২১ আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭) ‘(হে নবী!) আমি আপনাকে সব মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-৩৪ সাবা, আয়াত: ২৮) মনুষ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। নবী রাসুল প্রেরণের লক্ষ্য হলো মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তাই আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসুল (সা.)–এর পথ অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ রাসুল (সা.) যা যা করেছেন বা করতে বলেছেন, তা করতে হবে। আর যা করেননি বা করতে বারণ করেছেন, তা বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, ‘যা দিয়েছেন তোমাদের রাসুল (সা.) সুতরাং তা ধারণ কর; আর যা থেকে বারণ করেছেন, তা হতে বিরত থাক।’ (সুরা-৫৯ হাশর, আয়াত: ৭)
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব দিবসটি ফাতেহায়ে দোয়াজ-দহম নামে পরিচিত। ‘ফাতেহায়ে দোয়াজ–দহম’ কথাটি ফারসি ভাষা হতে আগত। দোয়াজ-দহম মানে বারো, ফাতেহায়ে দোয়াজ-দহম অর্থ বারো তারিখের ফাতেহা অনুষ্ঠান। কালক্রমে এ দিনটি মিলাদুন নবী (সা.) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এর অর্থ হলো নবী (সা.)–এর জন্ম অনুষ্ঠান। ধীরে ধীরে এর সঙ্গে ‘ঈদ’ শব্দ যোগ হয়ে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)’ রূপ লাভ করে। যার অর্থ হলো মহানবী (সা.)–এর জন্মোৎসব। এ পর্যায়ে আরেকটি পরিভাষারও প্রচলন ঘটে ‘সিরাতুন নবী (সা.)’ অর্থাৎ নবী (সা.)–এর জীবনচরিত বা জীবনী আলোচনা অনুষ্ঠান। পবিত্র কোরআনে বারবার বিবৃত হয়েছে, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)–এর মধ্যে সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সুরা-৩৩ আহযাব, আয়াত: ২১)
আসল কথা হলো, তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা; কোরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা; একমাত্র ইসলামকেই ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির অনন্য পথ হিসেবে গ্রহণ করা। তবেই আমাদের এ আনন্দ উদ্যাপন সার্থক হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তিনি সে মহান প্রভু, যিনি রাসুল প্রেরণ করেছেন, সঠিক পন্থা ও সত্য ধর্মসহযোগে, যাতে সে ধর্মকে প্রকাশ করতে পারেন সর্ব ধর্মের শিখরে।’ (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৩; সুরা-৪৮ ফাৎহ, আয়াত: ২৮) অতি পরিতাপের বিষয়, রবিউল আউয়াল মাস এলে আমরা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করি। বাণী আর বিবৃতি প্রচার করি কিন্তু ফরজ–ওয়াজিব আদায় করি না। হারাম সুদ পরিত্যাগ করতে পারি না। দুর্নীতি ও ঘুষ ছাড়তে পারি না। মিথ্যা বর্জন করতে পারি না। লোভ–হিংসা–মোহমুক্ত হতে পারি না। এমন হয় কেন? তবে কি নবীপ্রেমের তাৎপর্য আমাদের অন্তরে স্থান পেয়েছে? আল কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘বলুন (হে রাসুল সা.!) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসবে, তবে আমার অনুকরণ কর; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩১) এ আলোকে নিশ্চিত করে বলা যায়, রাসুল (সা.)–এর প্রতি ভালোবাসা ইমানের পূর্বশর্ত। হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মুমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি হব তার নিকট তার পিতা, পুত্র ও সকল মানুষ এবং যাবতীয় সবকিছু হতে প্রিয়।’ (বুখারি: ১৩-১৪)
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসা ও অহিংস নীতি বিশ্বশান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ‘হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন, ‘হে বৎস! যদি তোমার পক্ষে সম্ভব হয় যে তুমি এভাবে রাত-দিন অতিবাহিত করবে, তোমার অন্তরে কারও জন্য কোনো বিদ্বেষ থাকবে না, তবে তুমি তাই করো।’ তিনি আমাকে আরও বললেন, ‘হে বৎস! এটাই আমার সুন্নাত; যারা আমার সুন্নাতকে ভালোবাসল তারা আমাকেই ভালোবাসল, যারা আমাকে ভালোবাসল তারা জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ (মুসলিম: ২৭২৬)। লেখক: মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী,যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম smusmangonee@gmail.com