দীর্ঘ দিন পর সাংবাদিকদেও মুখোমুখি সিরাজুল আলম খান
(দেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খান। ষাটের দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাসদের তাত্ত্বিক গুরু মনে করা হয় তাকে। দীর্ঘদিন ধরেই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ সাংবাদিকদেও মুখোমুখি হয়েছেন কথা বলেছেন দেশের রাজনীতির অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বাপ্পী ও আনিকা মাহজাবিন। দৈনিক বণিকবার্তার সৌজন্যে সাক্ষাৎকারটি দৈনিক খবরপত্রের পাঠকদেও জন্য পত্রস্থ করা হলো। -বার্তা সম্পাদক)
প্রশ্ন: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল আলম খান: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে এক বছরেরও বেশি সময় বাকি। এখনই এ নিয়ে কোনো কিছু বলা ঠিক হবে না। আরো কয়েকদিন যাক, তারপর বলা যাবে। তবে নির্বাচন নির্বাচনের মতোই হবে। ২০১৪ সালেও হয়েছিল। ২০১৮ সালেও হয়েছিল। এবারো যেকোনোভাবে হোক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেই। আসন্ন নির্বাচন কেউ ঠেকাতে পারবে না।
প্রশ্ন: দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ এখন কোনদিকে যাচ্ছে?
সিরাজুল আলম খান: বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়েও এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। আরো পাঁচ-দশ বছর যাক। তখন হয়তো কিছু বোঝা যাবে। কিন্তু আগামী ৫০ বছর পরে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতির কী অবস্থা হবে, তা নিয়ে যাদের ভাবার কথা, তারা কেউ কিছু ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন একটা পরিস্থিতিতে আছে, তা নিয়ে যাদের ভাবার কথা তারা কি এখন কেউ কিছু ভাবে? দেশটা কীভাবে চলবে, তা বোঝা বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। এখনকার যারা রাজনীতিবিদ, তাদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কিছুই নেই। দেশের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না, যদি না নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়। নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। সঠিক হতে হবে। একজন বাঁকা, একজন সোজা হলে চলবে না। দেশটাকে যদি এখন আবার নতুন করে সাজানো যায়, তাহলে এখন যেমনটি হচ্ছে তেমনটি আর থাকবে না। অন্যথায় দেশটার যা কিছু ভালো সব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতার মতো বৈশ্বিক বিষয়গুলো দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে কি?
সিরাজুল আলম খান: প্রভাব তো ফেলবেই। যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের নীতিনির্ধারকরা শুরুর দিকে একরকম বলেছেন। এখন আরেক রকম বলছেন। কিন্তু যে যুদ্ধের সঙ্গে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র জড়িত, সেটি সাধারণ কোনো যুদ্ধ না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি যুদ্ধটাকে বুঝি? যুদ্ধের প্রভাব কোনদিকে গড়াতে পারে সে বিষয়ে আমাদের কোনো প্রস্তুতি আছে কি? গোটা বিশ্বেই রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশেও পড়বে।
প্রশ্ন: দেশের রাজনীতিতে বহিঃশক্তির প্রভাব আছে কি? থাকলে কতটুকু? আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
সিরাজুল আলম খান: নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতিতে বহিঃশক্তির প্রভাব রয়েছে। সামনের দিনগুলোয়ও থাকবে। আমাদের অবস্থার সুযোগে অনেক দেশ এখানে আকৃষ্ট হচ্ছে। সব শক্তিই আকৃষ্ট হচ্ছে। ভারত, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র—সবাই এখানে আকৃষ্ট হচ্ছে। পরিস্থিতি আকর্ষণ করার মতো বলে আকৃষ্ট হচ্ছে। এর সঙ্গে ভূরাজনীতিরও একটা প্রভাব আছে। সবাই চায় বাংলাদেশকে নিজ প্রভাববলয়ের মধ্যে নিয়ে নিতে।
প্রশ্ন: স্বাধীনতা আন্দোলনের গোটা ইতিহাসের সঙ্গে আপনার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে আপনারা স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর এখন পর্যন্ত কতটুকু অর্জন হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
সিরাজুল আলম খান: অনেক সময় সে বাংলাদেশটাই আছে বলে মনে হয় না। অথচ অনেক সুযোগ বা সম্ভাবনা ছিল। এই ৫০ বছর যেমন কেটেছে, তেমন কাটার কি দরকার ছিল? কী দুর্দশা বাংলাদেশে? রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে গেলে বোঝা যায় এত নোংরা দেশ। আমার কাছে মনে হয় এমন হওয়ার কোনো দরকার ছিল কি? দেশকে অনেক সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত! কিন্তু তা হয়নি। যখন যিনি ক্ষমতায় ছিলেন, দেশকে নিজের মতো করে চালিয়েছেন। এগুলোর কোনো ভালো ফলাফল পাওয়া যায়নি। গত ৫০ বছরে আমরা আসলে কতদূর এগিয়েছি তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? এ প াশ বছরে ইউরোপ, আমেরিকা বা দূরপ্রাচ্যের দেশগুলো কতটা এগিয়েছে, তা হিসাব করে দেখেছি? আমাদের সময়ের যারা রাজনীতিবিদ, তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। যারা আছেন, তারা যা বলেন ঠিক বলেন না। আর যারা বেঁচে নেই তারা থাকলেও খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না। তারা বক্তৃতা দিয়ে দেয়ালের চুন-সুরকি খসাতে পারতেন, দেয়াল সরাতে পারতেন না। এ প াশ বছরে যারা যখন ক্ষমতায় থেকেছেন, তারা তখন দেশকে নিয়ে নিজের মতো চিন্তা করেছেন। এতগুলো শাসনামল, ইতিহাসের এতগুলো ভাগ! একেক আমলে বাংলাদেশের ওপর একেক রকম অস্ত্রোপচার হয়েছে। কারো পিঠে এমন আট-দশটা অস্ত্রোপচার হলে তার পক্ষে কি আর সোজা হয়ে বসে থাকা সম্ভব? আবার স্বাধীনতার পর বেশকিছু বছর বাংলাদেশ সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। সামরিক শাসন অবশ্যই দেশের জন্য ভালো কিছু না। সামরিক শাসনের অধীনে কি আর দেশ ভালো থাকে? এরও একটা খারাপ প্রভাব তো পড়েছেই।
প্রশ্ন: আপনারা যখন ছাত্ররাজনীতি করেছেন, তখন ছাত্ররাজনীতিতে এক ধরনের আদর্শবাদী আবহ বজায় ছিল। সেই আদর্শ এখন কতটুকু উপস্থিত বলে মনে করেন?
সিরাজুল আলম খান: সকালের আকাশ যেমন থাকে, বিকাল বা গোধূলির আকাশ তেমন থাকে না। সময় ভিন্ন। আবহও ভিন্ন। তেমনি এখনকার ছাত্ররাজনীতির বিষয়টিও ভিন্ন। ছাত্ররাজনীতির আগের সেই জায়গাটিই তো নেই। আগে আমরা যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম এখন কি রাস্তা তেমন আছে? তখন তো সবার অফুরন্ত সময় ছিল। আমার পাশে যারা বসত, তারা আমার চেয়ে কথা বলত অনেক বেশি। ছাত্ররাজনীতি করার সময় আমাকে দেখাই যেত না। তিন-চারদিন কোথায় থাকতাম তা হয়তো আমিই জানি না। এমনও সময় গেছে আমি জানি না, চারদিন পরে আমাকে কোথায় দেখায় যাবে। বলা হয়, স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভেতর আপনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নিউক্লিয়াস একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল। সে সম্পর্কে বলুন। নিউক্লিয়াসকে আমরা বলতাম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। ওটা এত সতর্কতার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল, বাইরে থেকে কেউ কিছু বুঝত না। সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক বা কাজী আরেফ আহমেদ এরা কে কখন গোপনে কী করছে, তা কেউ কিছু বুঝত না। একজন হয়তো কোনোভাবে বুঝে ফেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তখন হয়তো আমি বা আরেকজন দূর থেকে ইশারায় মানা করল। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি সামাল দেয়া হলো। স্বাধীনতা, বাংলাদেশ বা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রচেষ্টা—এগুলোকে আমরা আলাদাভাবে দেখতাম না। আর আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিবৃতি দিতাম না। নিউক্লিয়াস তার সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশ মানেই নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াস মানেই বাংলাদেশ।
প্রশ্ন: স্বাধীনতার পর আপনাদের হাতে জাসদ গড়ে উঠল। পরে তা ভেঙে নতুন কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠন হলো। এসব ভাঙনের পেছনে আদর্শিক না অন্য কোনো বিষয় কাজ করেছিল?
সিরাজুল আলম খান: দল ভাগ হওয়ার পেছনে কারণ তো ছিলই। নয়তো এখানে একে অন্যের কাছ থেকে সরবে কেন? আমি নিজেও এখনো ভাবি যে ভাঙন কেন? জাসদ (ইনু) হওয়ার কোনো আদর্শিক কারণ ছিল? আম্বিয়া কেন ভাঙল? কিন্তু আমি জাসদকে কোনো দল-উপদল দিয়ে দেখি না। আমি রব, ইনু কাউকেই দল ভাগের ভিত্তিতে দেখি না। তারা অনেক কিছু করেছে। আ স ম আব্দুর রব এখনো আছেন। আশির কাছাকাছি বয়স। তিনি এখন আর কী করতে পারবেন? যা করে গেছেন যথেষ্ট।