হাসপাতালের বেডে শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত ৫ বছরের শিশু তৃষা। তার শরীরে বেশ জ্বর আর মাথা যন্ত্রণা। একবার বমিও হয়েছে। শনিবার সকালে হঠাৎ জ্বর এবং শরীরে ব্যথা হওয়ায় মা আসমা আক্তার তাকে দ্রুত নিয়ে আসেন হাসপাতালে। বেলা ২টার দিকে তাকে ভর্তি করেন যশোরের অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ভর্তির পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেছে, তৃষার ডেঙ্গু হয়েছে। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছে শিশুটি। যশোরের অভয়নগর উপজেলা লাগোয়া জেলা সদরের বসুন্দিয়া এলাকার বাসিন্দা ক্ষুদে ব্যবসায়ী শিমুল হোসেন ও আসমা আক্তার দম্পতির একমাত্র সন্তান তৃষা।
আসমা জানান, অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ধারণা করেন, মেয়ের ডেঙ্গু হয়েছে। তাই কালবিলম্ব না করেই হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন শিশুটিকে। কী ধরনের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে বড় ভাই শরিফুল ইসলামের জ্বর-গায়ে ব্যথা, মাথা যন্ত্রণা হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায় তার ডেঙ্গু হয়েছে। তারপর একে একে ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম, মা সাজেদা বেগম, স্বামী শিমুল, ভাসুর ফরিদ হোসেন এবং সর্বশেষ মেয়ে তৃষাও আক্রান্ত হয়েছে। ‘কেবল আমিই এখনও বাকি আছি’– মৃদু হাসিমুখে যোগ করেন তিনি। আসমা জানান, আজও ব্লাড নিয়েছে, মেয়েটির জ্বর কমছে না। মাথা যন্ত্রণা ও হাত-পা কামড়াচ্ছে।
সরেজমিন অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে (৫০ শয্যা) দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্যে আলাদা কর্নার করা হয়েছে। একপাশের ওয়ার্ডে নারীদের জন্যে, অপর পাশে পুরুষ রোগীদের। তৃষার পাশের বেডে রয়েছেন একই এলাকার গৃহবধূ মজিদা বেগম (২৬)। তিনি জানান, ডাক্তার বলেছেন, রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়লে তাকে রিলিজ করা হবে। অপর পাশে অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া মধ্যপাড়ার গৃহবধূ সখিনা বেগম (৩০)। জ্বর, গায়ে ব্যথা, মাথা যন্ত্রণা আর বমি হয়েছে দুইবার। ২২ অক্টোবর বিকালে ভর্তি হয়েছেন; রক্ত পরীক্ষায় প্লাটিলেটের সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার।
পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি চলিশিয়া এলাকার বিশ্বজিৎ দাস (৪০) বলেন, ‘অভয়নগরের ভাঙাগেট এলাকায় আমার সেলুনের দোকান। বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই জ্বর আর শরীরে প্রচ- ব্যথা অনুভূত হয়। স্থানীয় একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে ওষুধ সেবন করি। কিন্তু জ্বর না কমায় শনিবার হাসপাতালে ভর্তি হই।’
শঙ্করপাশা এলাকার কামাল হোসেনও (৪০) ভর্তি হয়েছেন শনিবার। রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার। ডাক্তার বলেছেন, দেড়লাখ না হলে রিলিজ করবেন না। পায়রা এলাকার বাবর আলী (৩৮), শঙ্করপাশা এলাকার আলীম মোল্লা (৪৫) প্রমুখ তিন দিন থেকে এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিচ্ছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স দেবীরাণী বিশ্বাস এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় আমাদের এখানে ভর্তি হয়েছেন ১১ জন; যাদের মধ্যে নারী ৪ এবং পুরুষ ৭ জন। মোট চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩১ জন; যার মধ্যে নারী ১০ এবং পুরুষ ২১ জন।’ হাসপাতালে রোগীর স্বজন শঙ্করপাশা খেয়াঘাট এলাকার আব্দুল গফ্ফার বলেন, ‘আমাদের গ্রামে কমপক্ষে ৮ জন এ যাবৎ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। নদীর ওপার এলাকায় এটি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় বাড়িতেই জ্বরের রোগী রয়েছে। অনেকেই পরীক্ষা করাচ্ছে না।’ তিনি জানান, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মশা নিধনে কোনও কর্মকা- এখনও নেওয়া হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি একই এলাকার রবিউল ইসলামের বড় ভাই রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাই ৬ দিন আগে ভর্তি হয় হাসপাতালে। তিন দিন আগে রিলিজ হয়; আবার আজ রবিবার সকালে তাকে ভর্তি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শ্রীধরপুর ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডে আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি।’
জানতে চাইলে শ্রীধরপুর ইউনিয়নের চেযারম্যান নাসিরউদ্দীন বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশিই বলা যায়। সেই কারণে বিভিন্ন এলাকায় চৌকিদার পাঠিয়ে এডিস মশা যেসব স্থানে ডিম পাড়তে পারে, সেগুলো বিনষ্ট করা হচ্ছে। তা ছাড়া, মসজিদভিত্তিক জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করা হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেহেতু বরাদ্দ নেই, সে কারণে মশা নিধনের ওষুধ ছিটানো হয়নি।’
এদিকে, নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর গাজী বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে এবার বৃষ্টিপাত খুব কমই হয়েছে। অল্প বৃষ্টিতে কোথাও কোথাও পানি জমে আছে; মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাব এবং ভয়াবহতার বিষয়ে কোনও প্রচার-প্রচারণা নেই।
তবে, নওয়াপাড়া পৌরসভার মেয়র সুশান্ত কুমার দাস বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় প্রচুর সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী। নাগরিকরা বেশ আতঙ্কিত। এডিস মশার বিস্তার রোধে পৌরসভা থেকে প্রতিদিন চারটি করে ওয়ার্ডে আমরা মশা মারার স্প্রে করছি। আশা করছি, খুব শিগগির এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটবে।’
চিকিৎসকরা যা বললেন: যশোরের সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, যশোর জেলায় গত তিন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় মোট ৫১৯ জন। যার মধ্যে অভয়নগর উপজেলাতেই ৩৯২ জন। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ৪৭৫ জনকে; আর অভয়নগরে ৩৬১ জন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৪৪ জন, তাদের মধ্যে অভয়নগরেই ৩১ জন রয়েছে। অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘গত আগস্ট মাসে এই উপজেলায় প্রথম ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। সেই মাসে ছিল ৫৩ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ১৫১ জন এবং আজকের দিন পর্যন্ত (২৩ অক্টোবর) ১৮৯ জন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি, ভবদহ জলাবদ্ধ এলাকা এবং শিল্পা ল এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছে।’ মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা গেলে এই রোগের প্রকোপ কমবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
যশোরের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নাজমুস সাকিব রাসেল বলেন, ‘এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে লার্ভা ছাড়ে; ঠিক তেমনি দিনের বেলা কামড়ায়। জেলার মোট আক্রান্তের ৮০ শতাংশই অভয়নগরে। এবারই যে বেশি আক্রান্ত, তেমন নয়। ২০১৮ সালেও একবার সেখানে বেশ আক্রান্ত হয়েছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, যেকোনও রোগই চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। সেক্ষেত্রে যেসব স্থানে স্বচ্ছ পানি জমতে পারে, তা ডাবের খোল, প্লাস্টিকের বোতল বা ওয়ান টাইম কাপ, ছাদ পরিষ্কার রাখা, ফ্রিজ বা এসির পানি যাতে না জমতে পারে সেই ব্যবস্থা করা, দিনের বেলায়ও মশারি টানানো, সর্বোপরি ব্যাপক হারে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে এলে এই রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘যদি সাইক্লোন সিত্রাং আঘাত হানে, তাহলে ভারি বৃষ্টিও হতে পারে। সেক্ষেত্রে জমে থাকা পানি থেকেও আরেক দফা প্রকোপের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, আশা করা যায়, শীত বাড়লে এই রোগ শেষ হয়ে যাবে।’