সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৪ পূর্বাহ্ন

জামালপুর সাহিত্যমেলায় হারুন হাবীব এর উদ্বুদ্ধকরণমূলক বক্তব্য

এম এ কাশেম জামালপুর :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২২

আমি সাহিত্যের মানুষ হলেও কবিতার মানুষ নই, যদিও যৎসামান্য গান ও কবিতা লেখা হয়েছে আমার। আমি গদ্যের মানুষ। অথচ জামালপুর সাহিত্য মেলায় আমাকে কবিতার আসরে বসিয়ে পরীক্ষার সম্মুখিন করা হয়েছে। এটি আমার প্রতি সুবিচার না হলেও আমি এর প্রতিকারের আর্জি তুলব না, কারণ কবি ও কবিতা আমি ভালোবাসী। লাভের দিকটাও কম কিছু নয় আমার ; কারণ যে জামালপুরের মাটি, নদীজলখালবিল ও আলোবাতাসে আমি বড় হয়েছি, তারই কবিদের সঙ্গে আজ বসবার সুযোগ পেয়েছি। এটি আত্মশ্লাঘার কম সুযোগ নয়। সত্যি বলতে কি, সরকারি আয়োজনে জামালপুর সাহিত্য মেলার খবরটি যখন কানে পৌঁছে তখন কিছুটা অবাকই হয়েছি। বানিজ্য মেলা, বস্ত্র মেলা, প্রযুক্তি মেলা, শিল্পমেলা, আয়কর মেলা থেকে শুরু করে বহুবিধ মেলাই হয় প্রতি বছর, কিন্তু সরকার থেকে সাহিত্য মেলার আয়োজন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে ব্যাপারটি প্রশংসারও এ কারণে যে, যে সাহিত্য জীবনের সত্য আবিস্কার করে, যে সাহিত্য নন্দন চর্চায় রত, যে সাহিত্য মানুষকে মানবিক করে, সেই সাহিত্য নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রশক্তি উদ্যোগি হয়েছে। অতএব সুবাতাসের ইঙ্গিত আছে বলে আমি নিশ্চিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে রাষ্ট্রশক্তিকে আদর্শনির্ভর বা নীতির শক্তিনির্ভর হতে হয়। সে আদর্শ ও শক্তির আরাধ্য কাজ গণমানুষের মঙ্গল সাধন করা। যারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হন তারা রাজনীতির আদর্শ ও শক্তির অবমূল্যায়ন করেন। আমার বিশ্বাস, সেই আরাধ্য কাজ সম্পাদন করতে রাজনীতির সাংগঠনিক শক্তির সাথে নৈতিক শক্তির সমন্বয় জরুরি। অনস্বীকার্য ভাবেই বলতে পারি, সাহিত্য ও শিল্পকলার চর্চা রাজনীতির নৈতিক ভিত রচনার সহায়ক হয়, জাতীয় রাজনৈতিক সংস্্কৃতিকে পরিশুদ্ধ করে। রাজনীতি নিজেই সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সৃজন অধ্যায়। কেউই অস্বিকার করবেন না যে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতিবিদের হাতে ; কবি, কথাসাহিত্যিক, গল্পকার, নাট্যকার, চিত্রকর বা চারু ও কারু শিল্পীর হাতে নয়। কিন্তু যে রাজনীতিবিদের হৃদয়ে কবিতা থাকে, যে রাজনীতিবিদ সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রেমী হন, তাদের শক্তি সমুন্নত হয় মঙ্গল সংস্কৃতির অন্বেষণে, অসংযম ও অসহীষ্ণুতা তাদের গ্রাস করতে পারেনা। আজকের এই কবিতা আসরে প্রবীন-নবীন যে কবিগণ যোগ দিয়েছেন তাঁরা সকলেই আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ। তারা সকলে মহত্বের অন্বেষণ রত, জীবনের মহত্তম রুপকল্প খোঁজার মানুষ। শক্তি ও অর্থবিত্তের প্রবল দোষণে তারা নেশাগ্রস্থ নন। তারা কাব্য রচনা করেন নিজের মনের কলমে, সব ক্ষুদ্রতা ছাড়িয়ে, সব অনিষ্ঠ ছাড়িয়ে মঙ্গলাবার্তা ছড়িয়ে। জামালপুরের মাটিতে আজকের এই সাহিত্যবাসরটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার ৫১ বছর পর। স্বাধীনতার সেই ঐতিহাসিক রক্তাক্ত অধ্যায়ে আমরা যারা সেদিন এই জামালপুরের রণাঙ্গনে যুক্ত হবার সুযোগ নিয়েছিলাম তারা সকলেই আজ বয়োবৃদ্ধ হয়েছি। এরই মধ্যে হরিয়ে গেছেন অগনিত মুক্তি সংগ্রামী যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে নিজেদের সর্বত্তোম সময় উৎস্বর্গ করেছেন। ১৯৭১ এর সৃষ্ট বাংলাদেশ উত্তরোত্তর নতুন-নবীনের কণ্ঠস্বরে মুখরিত হয়েছে ; তাদের কন্ঠস্বর আশীর্বাদের হোক, মঙ্গলের হোক এই প্রার্থনাই করি। আপনাদের মতো সৃজনশীল মানুষের অধিবেশনে বেশি কিছু বলার সুযোগ আমার নেই, কারণ আপনারা সকলেই গুণী ; আপনারা কবিতার মানুষ, প্রেমের মানুষ, সুগন্ধি ফুল ফোটাবার মানুষ। যারা প্রেমের বন্দনা করেন তারা কঠোর হতে পারেন না। সে কারণে, এক-দুটো একান্ত উপলব্ধির কথা বলতেই পারি। আমি বিশ্বাস করি, যে সমাজে মুক্ত সংস্কৃতির পথ রুদ্ধ হয়, সৃজনশীল সাহিত্য ও শিল্পকলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, সে সমাজ বন্ধাত্ব বরণ করে। এই বন্ধাত্ব এমন এক বন্দিশালা যা সমাজের সৃজনবিকাশ রুদ্ধ করে, সংকুচিত করে ; ঠিক যেমন গাছ কুঠুরিবদ্ধ হয়ে অসাড় হয়, নির্জীব হয়, পরিশেষে মৃত্যুবরণ করে। আমরা আমাদের স্বদেশে এমন সংস্কৃতি চাই যা সমাজকে উদার করবে, মুক্ত করবে, সৃজনশীল করবে, গতিশীল করবে, নতুন প্রাণে ভরিয়ে দেবে। আমাদের বাংলা কবিতার বাংলা, কাব্যের বাংলা, গানের বাংলা, প্রেমের বাংলা ; যা আমাদের গৌরবের ঠিকানা। কোনো উগ্রবাদ বা অপশক্তি যেন সে ঐতিহ্যকে আঘাত করে পরাস্থ করতে না পারে  তা যেন আমরা দেখি। জীবনের অর্থ কী ? মানুষের বেঁচে থাকার, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পাড়ি দেওয়ার কী অর্থ ? খুব গম্ভীর দার্শনিক তত্বে না গিয়েও বলা যায়, এই অর্থ জীবনকে সার্থক করা, জন্মকে সার্থক করা, তৃপ্ত করা। বাস্তবতা বা দুর্ভাগ্য যাই বলিনে কেন, সমাজ-সংসারের সিংহভাগ মানুষ কেবলই বিত্ত খোঁজে, ক্ষমতার দম্ভ খোঁজে! কিন্তু তাতেই কী জীবন সার্থক হয় ? হয় হয়তো কারো কারো, যারা সেভাবে দ্যাখেন। কিন্তু আমার মনে হয় জীবনের নিগুঢ় অর্থ নন্দনের অন্বেষণ করা, সুন্দরের অন্বেষণ করা, পবিত্রতার অন্বেষণ করা, ভালোবাসার খোঁজে পথচলা যা জীবনকে পরিশুদ্ধ করে, মনুষত্বকে বিকাশ করে। অথচ মানুষ লোভী হয়, অর্থ ও শক্তি লোভী হয়, তারা মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পর্যন্ত অপবিত্র করে, বিকৃত করে, সমাজকে কুলশিত করে ; এমন কি নারী ও পুরুষের প্রেমক্রিয়ার মতো অপার্থিব আনন্দের উপলক্ষকেও কেউ কেউ বিকৃতরুচিহীন করে ! এই বিকৃত যৌনাচার প্রবৃত্তির যে নিষ্ঠুর চিত্র চারদিকেতা মানুষকে আর মানুষ, পুরুষকে আর পুরুষ রাখতে পেরেছে বলে মনে হয়না। বহু নদনদী, খালবিল উপহার দিয়ে এই জামালপুরের প্রকৃতি অনন্তকাল ধরে আমাদের গৌরবান্বিত করে আসছে। যমুনা, পুরনো ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই, জিঞ্জিরাম, বানার, ছাতাল, রৌমারী, কালুডাঙ্গাসহ অগনিত স্রোতধারা আমাদের জীবনকে ঐশর্যমন্ডিত করেছে, দর্শনকে প্রভাবিত করেছে। এই মাটিতে জন্ম নিয়েছেন বহু কীর্তিমান যাঁরা প্রেমে, দ্রোহে, কবিতায়, শিল্পে, অভিনয়ে জাতীয় শ্রেষ্টত্ব লাভ করেছেন। আপনারা তাঁদেরই উত্তরসুরী। প্রার্থণা করি, আপনাদের হাতে কবিতা বিকশিত হোক, আপনাদের কলমে মনুষত্বের, সত্য ও সুন্দরের বিজয়সঙ্গীত রচিত হোক । অর্ধশতাব্দির ভাঙ্গাগড়ায় আমাদের অর্জন কম নয়, অপ্রাপ্তীর ভান্ডারও খালি নয়। আমরা অনেক সাফল্যই অর্জন করেছি, কিন্তু আমাদের প্রিয় স্বদেশকে মানবিক বানাতে পারিনি। এ ব্যর্থতা নগন্য নয়। আপনাদের মতো প্রেমীক সৃজনশীলদের কাছে সে কারণেই অনুরোধ, আসুন, মনুষত্বের দাবি নিয়ে আমরা সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করি, বহু শহীদের রক্তঋণে জড়ানো প্রিয় স্বদেশভূমিকে আমরা মানবিক বাংলাদেশ করি। অন্যথায় আমাদের গৌরব কলংকিত হবে। আপনাদের সকলের প্রতি আমার অশেষ শুভ কামনা রইল। জয়বাংলা। হারুন হাবীব, ৪ কার্তিক ১৪২৯, ২০ অক্টাবর ২০২২, জামালপুর। লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিুযদ্ধ গবেষক, বাংলা একাডেমির পুরস্কার প্রাপ্ত লেখকবাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর সাবেক মহাপরিচালক, সেক্টর কমান্ডার ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ-৭১ এর মহাসচিব।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com