বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২:০৯ অপরাহ্ন

মুহাম্মদ সা:-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি

আবরার নাঈম:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২২

জীবনে চলার পথে একজন মুমিনের আদর্শ হবে রাসূল সা:। সর্বক্ষেত্রেই তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করে চলবে। তাঁর সুন্নতের পুরোপুরি পাবন্দী করবে। আর এটিই আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে বেশি স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলের অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আহজাব-২১)। এ আয়াত থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়, মুমিনের আদর্শ হবে একমাত্র রাসূল সা:। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ মুমিনের আদর্শ বা আইডল নন। যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁকে বিবেচনা করা হোক না কেন! তাঁর চেয়ে উত্তম আদর্শ আর কেউ হতে পারে না। যুদ্ধের ময়দানে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। বাবা হিসেবে তিনিই সেরা বাবা। স্বামী হিসেবে বিবেচনা করলে তিনি সর্বোত্তম স্বামী। শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করলে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ও আদর্শবান শিক্ষক। রাসূল সা: সাহাবায়ে কেরামদের দ্বীন শেখানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন হিকমত অবলম্বন করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন অভিনব পদ্ধতিতে। তার কিছু নমুনা এখানে পেশ করেছি-
রাসূল সা:-এর শিক্ষাদানের পদ্ধতি: হজরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য। তোমাদের আমি দ্বীনি শিক্ষা দিয়ে থাকি। তোমাদের কেউ পায়খানায় গেলে কিবলামুখী হয়ে বসবে না ও কিবলার দিকে পিঠ দিয়েও বসবে না। আর ডান হাত দিয়ে শৌচকর্ম করবে না।’ তিনি ঢিলা ব্যবহারের নির্দেশ দিতেন এবং গোবর ও হাড় দিয়ে শৌচকর্ম করতে নিষেধ করতেন (সুনানে আবু দাউদ-৮)।
রাসূল সা: হলেন মুমিনের জন্য পিতৃতুল্য। অর্থাৎ একজন পিতা যেমন তার সন্তানদের বিভিন্ন আদব-শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনি রাসূল সা: ও আমাদের মাসয়ালা-মাসায়েল, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব ইত্যাদি বিষয়াবলি শিক্ষা দেন। অন্য হাদিসে রাসূলের শিক্ষাদানের সুনিপুণ পদ্ধতি ফুটে উঠেছে আরো চমৎকারভাবে। মুয়াবিয়াহ ইবনুল হাকাম আস-সুলামি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, একদা আমি রাসূল সা:-এর সাথে সালাত আদায় করি। সালাত অবস্থায় লোকজনের মধ্যকার এক ব্যক্তি হাঁচি দিলে জবাবে আমি ইয়ারহামুকাল্লাহ বলায় সবাই আমার দিকে (রাগের) দৃষ্টিতে তাকাল। তখন আমি মনে মনে বললাম, তোমাদের মাতা তোমাদেরকে হারাক! তোমরা আমার দিকে এভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছ কেন? মুয়াবিয়াহ রা: বলেন, সবাই রানের ওপর হাত মেরে শব্দ করতে থাকলে আমি বুঝতে পারি যে, তারা আমাকে চুপ করাতে চাইছে। বর্ণনাকারী উসমানের বর্ণনায় রয়েছে- আমি যখন দেখলাম, তারা আমাকে চুপ করাতে চাচ্ছিল, তখন (অনিচ্ছা সত্ত্বে¡ও) আমি চুপ হলাম। এরপর রাসূল সা: সালাত শেষ করলেন। আমার পিতা-মাতা তাঁর জন্য কুরবান হোক! তিনি আমাকে প্রহার করলেন না, রাগ করলেন না ও গালিও দিলেন না। তিনি বললেন, সালাতের অবস্থায় তাসবিহ, তাকবির ও কুরআন তিলাওয়াত ব্যতীত কোনো কথা বলা মানুষের জন্য বৈধ নয় অথবা রাসূল সা: যেরূপ বলার বললেন। এরপর দীর্ঘ হাদিসে ওই সাহাবি আরো বিভিন্ন বিষয়ে রাসূলের কাছে প্রশ্ন করলেন (সুনানে আবু দাউদ-৯৩০)।
সুনানে নাসায়ির বর্ণনায় এসেছে, ওই সাহাবি বলেন, আমি তাঁর আগে বা পরে তাঁর থেকে উত্তম শিক্ষক দেখিনি। এই ঘটনায় রাসূল সা: ওই সাহাবির ওপর রেগে যাননি ও বকাঝকা করেননি; বরং খুব শান্তভাবে তাকে বুঝিয়ে বললেন, এটি তো নামাজ, এখানে আল্লাহর জিকির, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনো কথা বলা বৈধ নয়। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি উম্মতকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কতটা উদার ও বিনয়ী ছিলেন। অন্য এক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত- এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল। তখন রাসূল সা: মসজিদের একপাশে বসা ছিলেন। সে সালাত আদায় করে এসে তাঁকে সালাম দিলো। নবী কারিম সা: বললেন, ‘ওয়ালাইকুমুসসালাম; তুমি ফিরে যাও ও সালাত আদায় করো। কারণ তুমি সালাত আদায় করোনি।’ সে ফিরে গিয়ে সালাত আদায় করে এসে আবার সালাম দিলো। তিনি বললেন, ‘ওয়ালাইকুমুসসালাম; তুমি ফিরে যাও ও সালাত আদায় করো। কারণ তুমি সালাত আদায় করোনি।’ সে ফিরে গিয়ে সালাত আদায় করে এসে তাঁকে সালাম দিলো। তখন সে দ্বিতীয়বার অথবা তার পরের বার বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে সালাত শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, ‘যখন তুমি সালাতে দাঁড়ানোর ইচ্ছে করবে, তখন প্রথমে তুমি যথানিয়মে অজু করবে। তারপর কিবলামুখী দাঁড়িয়ে তাকবির বলবে। তারপর কুরআন থেকে যে অংশ তোমার পক্ষে সহজ হবে, তা তিলাওয়াত করবে। তারপর তুমি রুকু করবে ধীরস্থিরভাবে। তারপর মাথা তুলে ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর সিজদা ধীরস্থিরভাবে। তারপর আবার মাথা তুলে বসবে ধীরস্থিরভাবে। তারপর এভাবেই তোমার সালাতের যাবতীয় কাজ সমাধা করবে।’ আবু উসমা রহ: বলেন, ‘এমনকি শেষে তুমি সোজা হয়ে দণ্ডায়মান হবে’ (সহিহ বুখারি-৬২৫১)।
ওই হাদিসে ওই সাহাবিকে বারবার নামাজের নির্দেশ দেয়ার কারণ ছিল, তিনি নামাজ পড়েছেন ঠিকই কিন্তু তাড়াহুড়ো করেছেন। ধীরস্থিরভাবে রুকু-সিজদা আদায় করেননি। অর্থাৎ তা’দিলে আরকান পালন করেননি। এ জন্যই রাসূল সা: তাকে বারবার বলেছেন, তুমি ফিরে যাও এবং সালাত আদায় করো। প্রথমেই তিনি ধমক দেননি। পরে দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার ওই সাহাবি বিনয়ের সাথে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে নামাজ শিখিয়ে দিন। পরে রাসূল সা: তাঁকে যথারীতি পূর্ণ নামাজ শিখিয়ে দিলেন। এই ছিল রাসূলের শিক্ষাদানের পদ্ধতি। উপরি উক্ত হাদিসগুলো থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়, দ্বীনি তালিম দেয়া এবং ছাত্রদের শাসন করার ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা ও হেকমত অবলম্বন করতে হবে। তবে সবসময় যে, শুধু হেকমত আর নসিহত করে বোঝাতে হবে বিষয়টি এমন নয়। মাঝে মধ্যে যদি ছাত্র শরিয়ত গর্হিত কোনো কাজে লিপ্ত হয় তাহলে তাকে শাসনও করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নির্ধারিত সীমারেখা মেনেই তাকে শাসন করতে হবে। অন্যথায় আল্লাহ না করুন যদি কোনো শিক্ষক রাগের বশবর্তী হয়ে অপরাধের চেয়ে বেশি শাস্তি দিয়ে থাকেন তাহলে এর জন্য অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সর্বক্ষেত্রে প্রিয় নবী সা:-এর আদর্শ মেনে চলার তাওফিক দান করুন, আমীন। লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম, ময়মনসিংহ সদর।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com