ঋণের সুদহার বেঁধে দিলে বড়রা উপকৃত হন, বি ত হয় ছোটরা। অর্থনীতির এ তত্ত্ব বহু আগে থেকেই চর্চিত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বাংলাদেশেও ২০২০ সালে সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করা হয়। সুদহার বেঁধে দেয়ার পর দেশের কৃষি খাতসহ কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের ঋণবি ত হওয়ার কথা উঠেছিল। এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণায় তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঋণের ক্ষেত্রে সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অংকের সুদ বাস্তবায়ন হওয়ার পর দেশের ধনিক শ্রেণী বা বড় উদ্যোক্তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন। আর ঋণবি ত হয়েছেন কৃষি ও সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। ব্যাংকগুলোর কনজিউমার, রিটেইল বা খুচরা ঋণের পোর্টফোলিও ছোট হয়ে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহারের বাঁধ তুলে দেয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ পেয়েছিল শিল্প খাত। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃহৎ শিল্প খাতের ঋণ বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ব্যাংকগুলোর কৃষি, সিএমএসএমই ও অন্যান্য খাতের ঋণ। গত অর্থবছর (২০২১-২২) ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশই গিয়েছে শিল্প খাতে। আর সিএমএসএমই ২৭ ও কৃষি খাত ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ঋণ পেয়েছে। ২০১৪ সালে বিতরণকৃত ঋণের ২৮ শতাংশ ছিল কনজিউমার, রিটেইলসহ অন্যান্য খাতে। সর্বশেষ অর্থবছরে এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের হার ১২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের তৈরি ‘ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অব ইন্টারেস্ট রেট ক্যাপস অ্যান্ড পোটেনশিয়াল পলিসি অপশনস: বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সুদহার বেঁধে দেয়া বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, সুদহার বেঁধে দেয়ায় ব্যাংকগুলো কৃষি, সিএমএসএমইর মতো ঋণ বিতরণে নিরুৎসাহিত হয়েছে। বিপরীতে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হয়েছে শিল্প খাত। বর্তমানে বেসরকারি খাতের ব্যাংকঋণের প্রায় ৬০ শতাংশই বড়দের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। একই সঙ্গে দেশের মূল্যস্ফীতির হারও রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। ব্যাংকগুলোতে ঋণের চাহিদা বাড়ছে। বিপরীতে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতির কার্যকারিতাও দুর্বল হয়ে এসেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষক দল বলেছে, বাজারভিত্তিক সুদ ব্যবস্থাই হতে পারে বিদ্যমান চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্য দূর করার একমাত্র সমাধান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঋণের সর্বোচ্চ সুদহারের বিষয়টি নিয়ে আমরা অবগত। দেশের মূল্যস্ফীতির দিকেও আমরা নজর রাখছি। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ঋণের সর্বোচ্চ সুদের চেয়েও বেশি। এজন্য সুবিধাজনক সময়ে ধীরে ধীরে সর্বোচ্চ সুদের ক্যাপ তুলে দেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় বিবেচনায় আছে। গবেষণা বিভাগের দেয়া প্রতিবেদনটি সম্পর্কেও আমরা জ্ঞাত আছি।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণের সুদহারকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে এনে বাংলাদেশে ব্যবসার ব্যয় কমানোর দাবিটি দীর্ঘদিনের। নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ এবং সব পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুদহারের সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার একটি যৌক্তিক ভিতও তৈরি হয়েছিল। মহামারীর মধ্যেই ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করেছে। বিশ্বের বহু দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও ওই সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সমর্থ হয়। তবে সাম্প্রতিক আর্থিক ও ঋণ পরিস্থিতি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুদহারকে বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে। গবেষক দল মনে করে, সুদহারকে চাহিদা ও জোগানের ওপর ছেড়ে দিলে মুদ্রানীতির হাতিয়ারগুলো আরো বেশি কার্যকর ও শক্তিশালী হবে। একই সঙ্গে এটি মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ভূমিকা রাখবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য গত জুলাইয়ে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে রেপোর সুদহার বাড়িয়ে অর্থপ্রবাহ কঠোর করার আভাস দেয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপোর সুদহার বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। বিষয়টি উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিকভাবে বর্তমানে ইতিহাসের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আগামী মাসগুলোয় মুদ্রানীতিকে আরো কঠোর করার প্রয়োজন হতে পারে। এ অবস্থায় সুদহারের সীমা প্রত্যাহার বা বাতিল না করে নীতি সুদহার বাড়ানো হলে সেটি অর্থনীতির বাস্তব খাতে কার্যকর নাও হতে পারে।
অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার পুরোপুরি বাতিলের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯ শতাংশ সুদহারের বাধ্যবাধকতা বাতিল করে ব্যাংকগুলোকে সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অংকের সুদে ঋণের জন্য নৈতিক অনুপ্রেরণা দেয়া যায়। সেটি না হলে এক অংকের সুদের ফলে এরই মধ্যে অর্জিত সাফল্য ম্লান হয়ে যেতে পারে। সুদহার বেঁধে দেয়ার সুবিধাগুলো তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দিলে এটি ঋণগ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীদের উচ্চসুদের অভিঘাত থেকে রক্ষা করে। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে সহজ করে। ঋণের নিম্নসুদহার উদ্যোক্তাদের তহবিল ব্যয় কমানোর পাশাপাশি তাদের মধ্যে অর্থপ্রবাহ বাড়ায়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান উৎসাহিত হয়। পণ্য উৎপাদন ও সেবার পর্যাপ্ততার কারণে ভোক্তাদের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে রক্ষা করে।
ঋণের সুদহার কমানোর নেতিবাচক দিকও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে বলা হয়, বৃহৎ ঋণের তুলনায় ব্যাংকগুলোর সিএমএসএমই ঋণের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি। এ কারণে ব্যাংকগুলো সিএমএসএমই খাতের ঋণ বিতরণ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ফলে এ খাতের শিল্প ও সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঋণপ্রাপ্তি থেকে বি ত হয়। মুনাফা কমে যাওয়ার শঙ্কা থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রিটেইল বা খুচরা ব্যাংকিং থেকে নিজেদের বিরত রাখে। এটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখা সম্প্রসারণেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সুদহার কমে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হয়। অনেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত তুলে নেয়। এ কারণে অনানুষ্ঠানিক ঋণবাজার ও দীর্ঘমেয়াদি সম্পদের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
নেতিবাচক দিকগুলো পর্যালোচনা করে গবেষক দল বলেছে, ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া কখনই সঠিক পদ্ধতি নয়। কারণ এটি বাজার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির কার্যকারিতায় তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিবেদনে এক অংকের সুদের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে বলা হয়, ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়ার কারণে দেশের সিএমএসএমইসহ অন্যান্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপরীতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে শিল্প খাত। বেসরকারি খাতে বিতরণকৃত দেশের মোট ব্যাংকঋণের প্রায় ৬০ শতাংশই এখন শিল্প খাতের দখলে চলে গেছে। ঋণের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সুদহার কম হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ঋণের চাহিদা বাড়ছে। বিপরীতে ব্যাংকে বিনিয়োগযোগ্য তারল্য বা আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধি কমানোর জন্য এরই মধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজারভিত্তিক সুদ ব্যবস্থাই হতে পারে বিদ্যমান চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্য দূর করার একমাত্র সমাধান। গত শতাব্দীতে ব্যাংকঋণের সুদহার বেঁধে দেয়ার রীতি বহুলভাবে চর্চিত হতো লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয়। আর আফ্রিকার দেশগুলোতেও সুদহার বেঁধে দিয়ে অর্থনীতিতে গতি আনার চেষ্টা হয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি দেখা গিয়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়ার রীতি পৃথিবীতে এখন প্রায় অচল। বাংলাদেশেও ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়। ওই সময় নভেল করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত ছিল বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক অর্থনীতি। ব্যাংকগুলোয় ঋণের চাহিদা ছিল যৎসামান্য। তবে করোনা পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা বেড়েছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে সাড়ে ৯ শতাংশে ঠেকেছে। এ অবস্থায় সব পক্ষ থেকেই ঋণের সুদহার তুলে দেয়ার দাবি উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা বলেন, কনজিউমার ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত আরো ৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। বিষয়টি মৌখিকভাবে ব্যাংকগুলোকে জানানো হয়েছে। আগামীতে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। তবে এখনই সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার তুলে দেয়ার সময় আসেনি। প্রসঙ্গত, এতদিন টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এক বছর ধরে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দরের সঙ্গে খুচরা বাজারের (কার্ব মার্কেট) দরে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়। ব্যাংকসহ সব পক্ষের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এক বছরের ব্যবধানে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।- বণিক বার্তা