বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক সুতোয় গাঁথা। তাই তো মূল্যস্ফীতি দমকা হাওয়ার মতো আমাদের কাছেও ধাবমান। বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা এখন বিপরীত দিকে ঘুরছে। অনুন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশেও একই ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে মূল্যস্ফীতির লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, যা ঐতিহাসিকভাবে এখন অনেক।
মূল্যস্ফীতির ফলে সাধারণ মানুষের নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে পণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি। প্রতি সপ্তাহে ৩ শতাংশের মতো দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের। এমনকি গত পৌনে চার বছরে খাদ্য খাতে পরিবারের ব্যয় ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। সেই সঙ্গে নিম্ন আয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের জীবনযাত্রা এবং খাদ্যপরিস্থিতির সবক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। দ্রব্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজারের সঙ্গে সংসার খরচের সমন্বয় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি আঘাত করেছে সব শ্রেণির মানুষকে। মধ্য ও নিম্নবিত্ত এবং বাঁধা আয়ের মানুষের কাছে এই আঘাত অসহনীয়।
পরিসংখ্যান মতে, দারিদ্র্য ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে; কিন্তু বর্তমানে খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা সেখানে শখ-আহ্লাদ মেটানো আকাশকুসুম কল্পনা।
গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২২-এ বাংলাদেশকে খাদ্যসংকটে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়, করোনা মহামারির সংকট কাটিয়ে উঠলেও বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ খাদ্যসংকটের মুখোমুখি। এভাবে ক্রমবর্ধমান হারে মূল্যস্ফীতি লাগামহীনভাবে চলতে থাকলে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ তকমাটি শিগিগর ‘ডাল ভাতে বাঙালি’-তে পরিণত হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে কর্মজীবীদের বেতন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ আর সেপ্টেম্বর মাসে তা হয় ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম যে গতিতে বাড়ছে, মজুরি সেই গতিতে বৃদ্ধি না পাওয়ায় ভোক্তার প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অর্থনীতির ভাষায়, মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকা জনজীবনের জন্য স্বস্তিদায়ক। ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকা মানেই মহাবিপদ। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে ক্রমান্বয়ে আমরা কতটা খারাপ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি তা সহজে অনুমেয়।
শুধু বৈশ্বিক সংকট নয়, মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাও। জ্বালানিসংকট, বিদ্যুৎসংকট ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে প্রয়োজনীয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদনব্যবস্থা হ্রাস পাচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতির প্রধান অন্তরায়। এছাড়াও দেশে আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেলে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আগের মতো থাকলেও কোনো কারণে ডলার যদি অবমূল্যায়িত হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পণ্যের জোগান কমে গেলে এবং দেশে অতিরিক্ত টাকার জোগান তৈরি হলে মূল্যস্ফীতি হয়। কোনো সন্দেহ নেই, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিনমজুর, কলকারখানার শ্রমিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষ, কমে যাচ্ছে জীবনযাত্রার মান। ভিন্ন দিকে বড় বড় ব্যবসায়ীর টাকার পাহাড় জমছে। স্বাভাবিকভাবে তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা। এক্ষেত্রে মূলত বৈশ্বিক রাজনৈতিক দর্শন ‘জিরো-সাম-গেম’-এর মতোই একজনের অর্জন এবং অন্যজনের লোকসানের সমান। অর্থাৎ কেউ জিতলে অন্য কেউ হেরে যাবে। এমতাবস্থায়, মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে প্রয়োজন বাধ্যতামূলক সঞ্চয় চালু করা, সরকারিভাবে দ্রব্যমূল্যের সীমানা বেঁধে দেওয়া, কম চাহিদাসম্পন্ন দ্রব্যের তুলনায় বেশি চাহিদাসম্পন্ন দ্রব্যের উৎপাদনে উৎসাহিত করা, আমদানিনির্ভর কমানো ও দেশজ পণ্য ব্যবহার বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং ব্যাংক খাতের ঋণের সুদহারের নির্ধারিত সীমা তুলে দেওয়া ইত্যাদি। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে এবং গণমানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা যে অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না করতে পারলে মহাবিপদ অনিবার্য!
লেখক :শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়