মানবতার বন্ধু, মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যিনি বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবন ও আদর্শের অসংখ্য দিকের মধ্যে অন্যতম হলো ‘ক্ষমা’। মানুষ বরাবরই প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতার হয়ে থাকে। নেতিবাচক যা নিজের সাথে ঘটে, সেই পরিমাণ নেতিবাচক বিপরীতে ঘটাতে না পারলে, আমরা শান্তি পাই না। সেই স্থান থেকে ক্ষমার মহান উদাহরণ দিয়ে গেছেন আমাদের বিশ্বনবী সা:। বিশেষ করে নিজের প্রতি হওয়া জুলুমকে হাসিমুখে মেনে ক্ষমা করে দেয়ার অন্যতম এক দৃষ্টান্ত মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:। তৎকালীন আরবের মানুষ রাসূল সা:-কে অত্যধিক বিশ্বাস করতেন, শত্রুরাও নিজেদের মূল্যবান সম্পদ রাসূল সা:-এর কাছে গচ্ছিত রাখত। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী অধ্যয়নে দেখা যায় তার চাক্ষুষ জাত শত্রুকে তিনি হাসিমুখে ক্ষমা করে দিলেন। নবুওয়তির শুরুর দিকে তিনি যখন তায়েফে উপস্থিত হলেন, সেখানে তায়েফ কর্তৃক আক্রান্তও হয়েছিলেন। তখন তাঁর পাশের খাদেম বলেছিল আপনি তাদের জন্য বদদোয়া করুন; তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায়। হজরত জিবরাইল আ: এসে বললেন, আপনি হুকুম দিন! তায়েফের দুই পাশের পাহাড় এক করে দিয়ে তায়েফবাসীকে ধ্বংস করে দিই। কিন্তু রাসূল সা: কী বললেন? না! আমি বদদোয়ার জন্য প্রেরিত হইনি। আমি রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। অবলীলায় ক্ষমা করে দিলেন ওই জঘন্য অমানুষগুলোকে। এ কারণেই তাকে বলা হয়েছে আদর্শের মূর্তপ্রতীক। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তাঁর মতো এমন উদার ও ক্ষমাশীল মানুষ ছিল না, এখনো নেই, কিয়ামত অবদি আসবেও না। মানবজীবনে ক্ষমার গুরুত্ব অপরিসীম, ক্ষমা মানুষকে বানায় মহৎ এবং দয়ালু। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে তার ‘ক্ষমা’ গুণটির কথা বর্ণনা করেছেন। সূরা বাকারার ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়ালু’।
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘(হে নবী) আপনি ক্ষমাশীলতা অবলম্বন করুন এবং মানুষকে ভালো বিষয়ের আদেশ করুন। আর মূর্খদের উপেক্ষা করুন’ (সূরা আরাফ-১৯৯)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: সাহাবিদের ক্ষমা প্রদর্শনের শিক্ষা দিতেন সর্বদা। এই মর্মে চমৎকার একটি হাদিস রয়েছে। হাদিসটি হলো- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত- এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলল, আমাদের গোলাম কর্মচারীরা তো ভুলত্রুটি করে থাকে; তাদের আমরা কতবার ক্ষমা করব?
উত্তরে রাসূল সা: কিছু না বলে চুপ রইলেন। লোকটি আবার প্রশ্ন করল। এবারো রাসূল সা: চুপ রইলেন। লোকটি যখন তৃতীয়বার প্রশ্ন করল- তখন রাসূল সা: বলেন, ‘প্রতিদিন তাকে ৭০ বার মাফ করে দেবে’ (আহমদ-৫৬৩৫)।
বর্তমান সময়ে আমরা ক্ষমা করে দেয়ার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছি। যার ফলে দিন দিন মানুষের মধ্যে মানুষ দয়াহীন হয়ে যাচ্ছে, সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। অথচ এক ‘ক্ষমা’ই পারে একটি সুন্দর, ঝামেলাহীন সমাজ উপহার দিতে।
ক্ষমা কখনো মানুষকে ছোট করে না; বরং ক্ষমা মানুষকে সম্মানিত করে তোলে। ‘যে বান্দা অত্যাচারিত হয়েও জালিমকে ক্ষমা করে দেয়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন’ (আহমদ-১/১৯৩)।
অন্য হাদিসে এসেছে- প্রিয় নবী সা:-কে একদিন এক ইহুদি বেদুইন সালাম দেয়ার পরিবর্তে বললেন, ‘আস-সামু আলাইকুম’ অর্থাৎ তোমার মৃত্যু হোক।
ইহুদির এ অভিভাদন শুনে হজরত আয়েশা রা: রেগে যান এবং বলেন, ‘তোমার মৃত্যু হোক, আল্লাহর লানত হোক তোমার ওপর।’ তখন প্রিয় নবী সা: বললেন, ‘হে আয়েশা! থেমে যাও। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা দয়াশীল; তিনি দয়া-মায়াকে ভালোবাসেন।’ অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন- ‘অতএব আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন’ (সূরা ইমরান: ১৫৯)।
রাসূল সা: তার পুরো জিন্দেগি ক্ষমার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। সর্বশেষ যাদের নির্যাতন ও অত্যাচারে প্রাণের ভয়কে পরোয়া না করে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন; সেই তিনি মক্কা বিজয়ের পর বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’ সুবহান আল্লাহ ! মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবন এবং আর্দশ ধারণ করে আমরাও যাতে সব উৎকৃষ্ট গুণাবলির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাই, সেই দোয়া সর্বদা। লেখিকা : শিক্ষার্থী, কামিল (হাদিস বিভাগ)