পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর পর দুদিনের মধ্যেই গ্রাহক পর্যায়ে ১৫-২০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির তোড়জোড় শুরু করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এরই মধ্যে বিদ্যুতের তিন বিতরণ কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) মূল্যবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বরাবর প্রস্তাব পাঠিয়েছে। একই উদ্দেশ্যে প্রস্তাব তৈরি করছে নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)।
চলতি সপ্তাহেই পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে বিইআরসি। কমিশনের গত সোমবার ঘোষিত নতুন সিদ্ধান্তে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৩ পয়সা বাড়ানোর ঘোষণার পর বিপিডিবির প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ২০ পয়সা। বিতরণ কোম্পানিগুলোকে ডিসেম্বর থেকে এ মূল্য পরিশোধ করতে হবে। ওই ঘোষণার দুদিনের মধ্যেই খুচরায়ও দাম বাড়াতে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর ভাষ্যমতে, পাইকারিতে দাম বাড়ানোয় বিদ্যুতের মূল্য বাবদ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় বেড়েছে। এজন্যই খুচরা বা গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর জন্য প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইছে কোম্পানিগুলো। বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রস্তাব পাঠানো বা তৈরির কথা স্বীকার করলেও বিইআরসি বলছে, এখনো এ ধরনের কোনো প্রস্তাব পায়নি কমিশন।
আবাসিক ছাড়া অন্য সব গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত সংস্থা ডিপিডিসি। গতকালই কমিশনে এ প্রস্তাব পাঠানো হয় বলে জানা গিয়েছে। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান এ প্রসঙ্গে বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বিইআরসিতে আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সুনির্দিষ্ট করে আমরা কোনো মূল্যবৃদ্ধির হার উল্লেখ করিনি। তবে আমাদের প্রস্তাবে আবাসিক বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে বাকি গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসার একদিন পর বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ওজোপাডিকো। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, ওজোপাডিকোর পক্ষ থেকে খুচরায় বিদ্যুতের দাম প্রায় ২০ শতাংশ বাড়নোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ওজোপাডিকোর মূল্যবৃদ্ধি-সংক্রান্ত আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন সংস্থাটির এমডি প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম। জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমরা কমিশনে আমাদের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ার পর বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী আমাদের খরচ বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
বিপিডিবির পক্ষ বিইআরসিতে গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে সংস্থাটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, খুচরা পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে বিপিডিবি। সে অনুযায়ী, বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি খুচরা মূল্য ৭ টাকা ৫৬ থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৩ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।
তিন বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাঠানোর তথ্য নিশ্চিত করা হলেও বিইআরসি বলছে, এখনো প্রস্তাবগুলো হাতে পায়নি কমিশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসির সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ আবু ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা কোনো বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে এখনো কোনো প্রস্তাব পাইনি। (গত বুধবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত) আমাদের হাতে কোনো প্রস্তাব আসেনি। শুনেছি দু-একটি বিতরণ কোম্পানি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমাদের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব এলে আমরা সেটি যাচাই করে দেখব। অন্য তিন বিতরণ কোম্পানিও আজ-কালের মধ্যেই বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠাবে বলে জানা গিয়েছে। বিইআরসিতে আজই গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠাতে পারে নেসকো। বর্তমানে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে সংস্থাটি। নেসকো-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর পর কোম্পানিগুলো পরিচালনা করতে হলে গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে কত শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হবে সে বিষয়ে হিসাব-নিকাশ চলছে। সংস্থাটির অন্তত দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের হিসাব অনুযায়ী পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে। বিদ্যুতের দাম যেহেতু প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে, সেক্ষেত্রে সংস্থাটি ২৫-৩০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির এমডি জাকিউল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, নেসকোর পক্ষ থেকে আজ বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠানো হবে। বিতরণের ব্যয় হিসাব করে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম যতটুকু বাড়ানোর প্রয়োজন, সেটুকুই প্রস্তাব করা হবে। আমরা হিসাব-নিকাশ করছি। এরপর কতটুকু বাড়বে সে বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।
বিআরইবিও বিইআরসি বরাবর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিতে পারে বলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির পর বিআরইবির ইউনিটপ্রতি খরচ বেড়েছে ১ টাকা ৮ পয়সা। এ খরচ বিবেচনায় নিয়েই বিআরইবির পক্ষ থেকে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। বিআরইবির সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আমজাদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব আশা করছি আজ বিইআরসিতে পাঠিয়ে দেব। পাইকারি দাম বিবেচনায় গ্রাহক পর্যায়ে ১৬-১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত আরেক সংস্থা ডেসকো। দু-এক কার্যদিবসের মধ্যে সংস্থাটির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির তোড়জোড় দেখা গেলেও বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে ভিন্ন কথা। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর ২১ নভেম্বর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আপাতত বাড়ছে না। এটি নিয়ে গ্রাহকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর বিপিডিবির পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একটি প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল বিইআরসি। সে সময় কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিপিডিবির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি ত্রুটিপূর্ণ। একই সঙ্গে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়লে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সেটিরও কোনো ব্যাখ্যা ছিল না বিপিডিবির প্রস্তাবে। তবে এতে সিদ্ধান্তে রিভিউ আবেদনের সুযোগ রাখা হয়। প্রসঙ্গত, বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষে চাইলেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। এজন্য পাইকারি বা খুচরায় বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলে কোম্পানিগুলোকে আগে বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠাতে হয়। এ প্রস্তাব যাচাইয়ের পর গণশুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। গণশুনানি শেষে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে মূল্যসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেয় কমিশন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণ আলোচনা চলাকালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিরা। এ সময় বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে মূল্য সমন্বয়ের পরামর্শও দেয়া হয়। এছাড়া বিইআরসির সঙ্গে আলোচনায় আইএমএফের প্রতিনিধিরা গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এবং একাধিকবার মূল্য নির্ধারণের সুযোগ সম্পর্কেও জানতে চান। ধারণা করা হচ্ছে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনে রিভিউ প্রস্তাব পাঠায় বিপিডিবি। এ রিভিউ প্রস্তাবের ভিত্তিতেই সোমবার পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি।