যেকোনো দেশের অর্থনীতির বর্তমান হালচাল বিচার করতে গেলে, প্রথমেই যেসব বিষয় সামনে চলে আসে তা হলো- সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন নির্দেশক, বাজার ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক নীতিমালাসমূহ। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ‘সার্বিক চাহিদা’ বা অর্থনৈতিক পরিভাষায় ‘জিডিপি’ অথবা ‘সার্বিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন’ বৃদ্ধি করা। অতপর এ লক্ষ্য অর্জনে যথাযথ নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো। বেসরকারি ভোগ ও সরকারের ব্যয় সার্বিক চাহিদার সাথে সম্পর্কিত দু’টি অপরিহার্য অঙ্গ-উপাদান। সামষ্টিক অর্থনীতির আরো একটি অন্যতম প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো- মূল্যস্ফীতিকে স্থিতিশীল, নি¤œমুখী ও নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ উদ্দেশ্য অর্জনে জরুরি বিষয় হলো, সার্বিক মোট চাহিদাকে একটি নির্দিষ্ট সীমা বা গ-ির মধ্যে ধরে রাখা। তবে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এসব অঙ্গ-উপাদানের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। এর অর্থ হলো, পরিকল্পনামাফিক চাহিদা বাড়ানো, যাতে করে দেশের অব্যবহৃত সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করা যায়। একই সাথে, দেশের সম্ভাব্য উৎপাদন সামর্থ্যকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়। মোটকথা হলো, সামষ্টিক অর্থনীতির নির্দেশকগুলোকে একটির সাথে অপরটির সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করে দেশের জন্য ক্রমাগত ভাবে সম্পদ সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা। মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সব নির্দেশকই নিরন্তর পরিবর্তনশীল। এগুলো একটির সাথে অপরটি পরস্পর সম্পর্কিত ও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সরকার যদি সামষ্টিক অর্থনীতির কোনো বিশেষ নির্দেশকের লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, যেমন- জিডিপির দ্রুত প্রবৃদ্ধি, তাহলে অন্য নির্দেশকগুলোকে অবশ্যই যুগপৎ বিবেচনায় নিতে হবে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির হালচাল বিশদভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে গেলে যেসব বিষয় বিচার, বিবেচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন, সেগুলো হলো- ক. সার্বিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার অর্থাৎ সার্বিক চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি করা; খ. বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা; গ. কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব কমানো; ঘ. বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য রক্ষা করা অর্থাৎ রফতানি ও আমদানির মধ্যে একটি ভারসাম্য (রেমিট্যান্স ও অন্যান্য অন্তঃপ্রবাহসহ) রক্ষা করা; ঙ. বৈদেশিক মুদ্রার সাথে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা; চ. মূল্যস্ফীতির লাগাম ধরে রেখে একটি নির্দিষ্ট হারের নিচে রাখা। সামষ্টিক অর্থনীতির এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এ স্থিতিশীলতা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনসাধারণের সার্বিক অর্থনৈতিক কল্যাণের ইঙ্গিত বহন করে। যেমন- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি সার্বিক উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় বাড়ে তাহলে ধরে নেয়া হবে যে, সার্বিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য দিকে, আবার এই প্রবৃদ্ধির অর্থ হওয়া উচিত অধিক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে; মূল্যস্ফীতির হার নি¤œ হয়েছে। নি¤œমাত্রার স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতি প্রকৃত আয় বৃদ্ধির সহায়ক। সেই সাথে অনুকূল বাণিজ্যিক ভারসাম্য, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য ও আর্থিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অতএব বলা যায়, সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সার্বিক উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা কিভাবে আসে : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন যাই হোক, সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা থাকা অতীব প্রয়োজন। তবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমস্যা হলো- বিভিন্ন নির্দেশকের সম্পর্ক পরম্পরার মধ্যে যে জটিলতা, প্রথমে সেগুলোকে ধর্তব্যে আনা। তারপর নির্দেশকগুলোর বর্তমান হালচাল বিবেচনা করে ভবিষ্যতে সেগুলোতে ইতিবাচক ফলাফল অর্জনের পরিকল্পনা করা। অতপর নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাওয়া। একই সময় অন্য কোনো নির্দেশকের অবাঞ্ছিত নেতিবাচক পরিণাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। স্বভাবগতভাবে সামষ্টিক অর্থনীতির একটি নির্দেশক বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনার পথে আরেকটি নির্দেশকে অবাঞ্ছিত পরিবর্তন আসতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার বাড়ানোর প্রয়াসে সার্বিক চাহিদা বাড়ালে প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে, যা স্বতন্ত্রভাবে বাঞ্ছিত বটে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি যদি একটি নির্ধারিত সীমার গ-ির ভেতরে না রাখা হয় ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ব্যবস্থাপনা যদি সমন্বিতভাবে না হয়, তাহলে অনিবার্যভাবেই বিভিন্ন ধরনের ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। যেমন, সার্বিক চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে যদি অতিমাত্রায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যায় এবং সেই সাথে যদি রফতানি না বাড়ে, তা হলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাবে। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেলে বিদেশের সাথে আর্থিক লেনদেনের দায়-স্থিতি পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। দায়-স্থিতির অবনতি ঘটলে নিজস্ব মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটবে।
খাদ্যপণ্য থেকে শিল্প উৎপাদনে কাঁচামাল, এসবই আমদানিনির্ভর বিধায়, উৎপাদন খরচ ও মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি যত বাড়বে, উৎপাদন খরচ ততই বেড়ে যাবে। একই সাথে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় যদি না বাড়ে, তাহলে তাদের জীবনমানের অবনতি ঘটবে। এমনকি দরিদ্র্যতার হার বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে সেটিই আজ ঘটছে। সে জন্য নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই এসব নির্দেশকের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়াকে ধর্তব্যে এনে, হিসাব-নিকাশ করে সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক ছিল যাতে করে এসব নির্দেশকের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য থাকে ও যথাযথ ভারসাম্য থাকে। দুঃখের বিষয় হলো- বর্তমানের অনির্বাচিত ও স্বেচ্ছাচারী সরকার জনকল্যাণে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে। অতএব ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করার জন্য যে মেধা ও সামর্থ্য প্রয়োজন, সেটি এই দলবাজ ও দুর্নীতিবাজদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পর্যালোচনায় বোঝা যায়, একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারী শাসন, দলীয়করণ, দলীয় লোকদের তোষণ-পোষণকে বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতিতে পরিণত করে ফেলেছে। অন্য দিকে, আবার এই সরকার জনগণের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে নিজেদের কব্জায় নিয়ে ধ্বংস বা দুর্বল করে দিয়েছে। ফলে বাজার ব্যবস্থাপনা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জনগণের কল্যাণে যথোপযুক্ত নীতি-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরিবর্তে আত্ম-স্বার্থসন্ধানী রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক অর্থাৎ বিশেষ স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর লুটপাটে সহায়তা করতে আইন-কানুন-নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যেমন ধরুন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের টেন্ডার প্রণয়ন, ক্রয়প্রস্তাব বা ক্রয়াদেশ দেয়া নিয়ে এই দুর্নীতিবাজ সরকারকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না বা আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। এক কথায়, সরকারদলীয় ব্যবসায়ীদের তোষণ-পোষণ, দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাটকে আইনি সুরক্ষা দেয়া হয়েছে।
পৃথিবীতে অন্য কোনো দেশে আইন করে লুটপাটকে বৈধ করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। একইভাবে মেগা প্রজেক্টে হোক কিংবা খেলাপি ঋণ মাফ হোক, ব্যাংক বা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করা হোক, সব আইন-কানুন-নীতিই আজকাল আত্ম-স্বার্থসন্ধানী দুর্নীতিবাজদের সহায়তায় প্রণীত হচ্ছে। এসব আইন-কানুন, রীতি-নীতি বাস্তবায়নে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বড় বড় দুর্নীতিবাজ দলীয় কর্মকর্তাদের। তারা চাটুকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এমনসব লজ্জাজনক পরিসংখ্যান জনসমক্ষে হাজির করছে যা পুরো দেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেটি দেশের জনসংখ্যা নির্ণয় হোক, কিংবা প্রবৃদ্ধির হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অথবা মূল্যস্ফীতির হার হোক, সবই মিথ্যা নম্বর দিয়ে মিলিয়ে দিচ্ছে। ফলে কেবল দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী নয়, এমনকি কোনো বিদেশী সংস্থাও আজকাল আর বাংলাদেশ সরকারের দেয়া কোনো তথ্য বিশ্বাস করে না। এই মিথ্যাচারী, চাটুকার ও তোষামোদকারী কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার বয়স হলেও তারা আবার পুনর্নিয়োগ পায়। কয়েকবার পুনর্নিয়োগ পাওয়ার পর অবসর দেয়া হলেও তারা মৌমাছির মতো মধু খাওয়ার জন্য আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে।
অতপর এই চাটুকারদের আবার বিভিন্ন সংস্থা যেমন- ব্যাংক, বীমা, বিমান, এমনকি নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। দীর্ঘদিন বিভিন্ন পদে থাকার ফলে এই পেশাদার চাটুকাররা লুটপাট ও দুর্নীতিতে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ বনে যান। তাই স্বৈরাচারী শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে এবং এই লুটেরা গোষ্ঠীকে দুর্নীতিতে সহায়তা করার জন্য এদেরকেই বারবার পুনর্নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। এরাই স্বার্থান্বেষী মহল যেমন- প্রশাসনে অনভিজ্ঞ ও অনির্বাচিত রাজনীতিবিদদের সাথে মিলেমিশে দেশের বর্তমান রাজনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে এবং ভবিষ্যত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে হুমকির মুখে ফেলে বিপন্ন করে তুলেছে; যদিও সাধারণ অর্থে মনে হবে যে, এসব অর্থনীতির বিষয় নয়, কিন্তু অর্থনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা ও রাজনীতি এসবই একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যাই হোক, অর্থনৈতিক সমস্যায় ফিরে যাই।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখানো যায় না : সামষ্টিক অর্থনীতির নির্দেশকগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তর্নিহিত অর্থ হলো- সামষ্টিক অর্থনীতির অপরিহার্য উপাদান যেমন সার্বিক চাহিদা বা সার্বিক দেশজ উৎপাদনের পরিমাণগত সম্প্রসারণ। এই সম্প্রসারণের সাথে আবার মোট জাতীয় আয় ও জনগণের মাথাপিছু আয়ের তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে। কারণ এগুলোর পরিমাণ দিয়ে নিরূপণ করা হয় সার্বিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বা সার্বিক জাতীয় আয়ের পরিমাণ। সে কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ করার জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন নির্দেশক বা সূচকের পরিবর্তনের পরিমাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে জাতীয় আয় বৃদ্ধি, জাতীয় সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও দেশে মূলধন গঠনের গতি-প্রকৃতির একটি সরাসরি সম্পর্ক আছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলতে সাধারণত প্রবৃদ্ধির পরিমাণগত বৃদ্ধিকে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু নির্দেশকগুলোর মধ্যে একটি আন্তঃসম্পর্ক আছে। তাই এসব নির্দেশক একত্রে হিসাবে আনা ও বিবেচনা করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, অর্থনীতির সংজ্ঞা ও তত্ত্বানুযায়ী, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এক নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেবল অথনৈতিক উন্নয়নের পরিমাণগত রূপ বা চেহারা। বিগত দু’শতাধিক বছরের কালপরিক্রমায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া চলছে। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে আজ পর্যন্ত উন্নয়নের যে প্রক্রিয়া চলেছে, তার সুফল হিসেবে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজ দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভ করেছে। এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ঢেউ জাপানে লেগেছে মাত্র শত বছর আগে। নতুন শিল্পায়িত এশীয় অর্থনীতির দেশগুলোতে মাত্র ৫০ বছর আগে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে কম সময়ের মধ্যে দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের বোঝা থেকে মুক্তি অর্জন করাই হলো জাতীয় উন্নয়নের বাধ্যবাধকতা ও অভিন্ন লক্ষ্য। বাস্তবিকপক্ষে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির আশু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জরুরি ভিত্তিতে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো ও দারিদ্র্যের হার কমিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। তারপর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, উন্নত দেশগুলোর সমপর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্যে জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন ধারার প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা। তবে বর্তমান স্বৈরাচারী দলীয় সরকারের অধীনে এ ধরনের জাতীয় ঐক্যের কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই চলে। এ জন্যই বর্তমান স্বৈরাচারী ও অনির্বাচিত সরকার কর্তৃক সৃষ্ট অর্থনীতি এবং রাজনীতির সমস্যা সমাধান করে দেশকে সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে বিএনপি যথার্থভাবেই নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। অন্য দিকে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো এমন এক প্রক্রিয়া যা কেবল পরিমাণগত সম্প্রসারণের সাথে নয়; বরং পরিমাণ করা যায় না এমন সব বিষয়ের পরিবর্তনের সাথেও সম্পর্কিত। এ প্রক্রিয়ার সাথে প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের চাহিদা পূরণে সামর্থ্য অর্জন, মানুষের দৈহিক নিরাপত্তা ও সংস্কৃতি অর্থাৎ যে পরিবেশে অর্থনীতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় ও যেসব মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটে, সেসব বিষয়কে ধর্তব্যে আনা হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থনীতির একটি কার্যকর তত্ত্ব। উল্লিখিত এই তত্ত্ব ইতিহাসে বর্ণিত সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলোর মধ্যে নিহিত আছে। অতএব বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত বা কম আয়ের অর্থনীতিতে(Low Income Country) যদি উন্নয়নের গতি বাড়াতে হয় তাহলে অন্যান্য উন্নত দেশের অতীত উন্নয়নের প্রক্রিয়া, সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলোর সাথে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের বর্তমান পরিস্থিতির তুলনাভিত্তিক মূল্যায়ন আবশ্যকীয়। এখানে বলে রাখা ভালো যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা সার্বিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি (GDP growth) স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে (economic development) রূপান্তরিত হয় না। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন এ দুয়ের পার্থক্য যাই হোক না কেন, দেশে সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। অতএব বলা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত।ভেঙে পড়েছে সামষ্টিক অর্থনীতির হাতিয়ার : সামষ্টিক অর্থনীতির বাঞ্ছিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নীতিনির্ধারকদের হাতে নানা ধরনের কিন্তু মুষ্টিমেয় হাতেগোনা যে কয়েকটি হাতিয়ার আছে, সেগুলো হচ্ছে- ক. রাজস্বনীতি অর্থাৎ করারোপ ও ব্যয় নীতি; খ. মুদ্রানীতি অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহ নীতি ও সুদের হার এবং গ. বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার। এগুলোর সাথে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ, সংগঠন ও সুবিন্যস্ত প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন (Institutions and Institutional Arrangements) এবং সেগুলোর কার্যকারিতা ইত্যাদি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
সব দেশেই সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের রাজস্ব নিধি বা ব্যাংকার। মুদ্রানীতির বিষয়টি সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই ন্যস্ত থাকে। মুদ্রানীতিকে হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের গোটা অর্থনীতিতে যে পরিমাণ অর্থের প্রবাহ থাকা বাঞ্ছনীয় তা নিয়ন্ত্রণ করে এবং একই সাথে এই হাতিয়ার ব্যবহার করে সরকার ও ভোক্তা উভয়ের চাহিদা এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে। বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনের সাথে ব্যক্তির ভোগ (private consumption) ও সরকারি ব্যয় (public expenditure) উভয়ই সার্বিক চাহিদা পরিমাপের অন্তর্ভুক্ত। অবস্থাদৃষ্টে বলতে হয়, বিগত দশকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের চরিত্র বদলিয়ে এখন দলীয় সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। এসব থেকে জাতি কিভাবে পরিত্রাণ পাবে তার পথ খুঁজে বের করা এখন অতি আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে, সরকারের সার্বিক ব্যয় যদিও সামষ্টিক অর্থনীতির কার্যধারার ক্রিয়াকলাপ, তবে এটি ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক (Micro, Macro) উভয় অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যয় আলাদা আলাদা হিসাবে আনলে সেটি রাজস্বনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যষ্টিক (micro) অর্থনীতির বিষয়। তবে সরকারের মোট আয় (শুল্ক কর, আয়কর, সংযোজন মূল্যের ওপর কর ও অন্যান্য আয়) ও ব্যয়ের আনুপাতিক পরিমাণের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সেটি সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম হাতিয়ার। এর কারণ, বাজেট উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি যাই হোক, এটি সামষ্টিক অর্থনীতির নির্দেশকগুলোর ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
কেননা, সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন নির্দেশকের নির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন নির্ভর করে এই হাতিয়ারের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে। উদ্বৃত্ত বাজেট অর্থনীতিকে সম্প্রসারণ করার সুযোগ করে দেয়। অন্য দিকে, ঘাটতি বাজেট মানেই ধার-কর্জ করে ঘাটতি পূরণ করতে হবে। বিগত কয়েক বছরে স্বৈরাচারী সরকারের ভ্রান্তনীতি অনুসরণে বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। হোক সেটি বাজেট ঘাটতি, বিদেশের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনে ঘাটতি বা আর্থিক দায়-স্থিতিতে ঘাটতি। এসব বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের যৌক্তিকতা : বাজেটে ঘাটতি (সরকারের আয় থেকে ব্যয় বেশি) হলে সরকারকে বাধ্য হয়ে ধার নিতে হয়। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য যৌক্তিক পর্যায়ের বাজেট ঘাটতি বা সম্প্রসারণমূলক রাজস্বনীতি অনভিপ্রেত কিছু নয়। সরকার যদি পরিকল্পিতভাবে একটি সীমার মধ্যে থেকে ঋণ গ্রহণ করে, সেটি অর্থনীতির জন্য সর্বদা ক্ষতিকর নয়। তবে অপরিকল্পিত ও অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত মাত্রায় ঋণ নেয়া অর্থনীতির জন্য সবসময় সমস্যা সৃষ্টি করে। ঋণ করে অতিরিক্ত ব্যয় করার (সম্প্রসারণমূলক রাজস্বনীতি) বিষয়টির উদ্দেশ্য প্রায় সব দেশে সব সময় একই। সব সময় বলা হয়, ঋণ নেয়ার উদ্দেশ্য হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেয়ার পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য যতটুকুই হোক, তার চেয়ে বেশি থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আর এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের নেপথ্যে থাকে (বিশেষ করে সরকারের মেয়াদের শুরু ও শেষের দিকে) স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতিকে জোরদার দেখানো বা প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো। অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ভর্তুকি ও সামাজিক বেষ্টনীর আওতার পরিধি বাড়ানো।
তবে বর্তমান সরকারের মতলব হলো- বিগত সরকারের চেয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক সাফল্যকে অবাঞ্ছিত উপায়ে জাহির করা। এসব ভ্রান্ত নীতির ফলে সমাজে দুর্নীতি, লুটপাট ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় বেড়ে গেছে যা এখন হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে এখন নির্বাচিত সরকার নেই। তাই বিদ্যমান অনির্বাচিত সরকার কোনো রীতি-নীতি মানার তেমন কোনো প্রয়োজন মনে করে না। এ ছাড়া সরকার যত খরচ করুক, বাজেট ঘাটতি, বাণিজ্য ঘাটতি বা বিদেশের সাথে দায়-স্থিতি যাই হোক, এতে সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তবে প্রকৃত অবস্থা যাই হোক- চাটুকার, তোষামোদি ও দলীয় আমলাদের সহায়তায় এই সরকার মিথ্যা পরিসংখ্যান দিয়ে সব হিসাবকে যৌক্তিক সংখ্যার মধ্যে রেখে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে কেউ আর সরকারের ঘোষণাকৃত পরিসংখ্যান বিশ্বাস করে না। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা মূল্যস্ফীতি, বা বাণিজ্য ঘাটতি, যাই হোক না কেন, কোনো হিসাব এখন আর মেলানো যায় না বা কেউ মেলাতে পারে না।
এক কথায় বলা যায়, এ ধরনের মিথ্যা পরিসংখ্যান জনগণ ও দেশের প্রতি চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়। আগেই বলেছি, কোনো কোনো সময় রাজস্বনীতিকে সামষ্টিক অর্থনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্পমেয়াদের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দ্রুততর করার বিষয়টি অযৌক্তিক নয়। এমনকি সমর্থনযোগ্য যদি এসব পরিকল্পনা দায়িত্ব নিয়ে করা হতো। সাময়িকভাবে সম্প্রসারিত রাজস্বনীতি বা অতিরিক্ত ব্যয় যদি দেশে বিনিয়োগের সাথে সম্পর্কিত হয়; যেমন- বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করে যদি সর্বোত্তম উপায়ে ব্যবহার করা হয়। অথচ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো হলেও প্রাথমিক জ্বালানি জোগানে সামর্থ্য না থাকায় ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
তা ছাড়া উৎপাদন যাই হোক, প্রথম দিকে সঞ্চালন লাইনের অভাবে গ্রাহকের কাছে বিতরণ করা যায়নি। অতএব এ ধরনের অপরিকল্পিত বিনিয়োগকে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দেশের সম্পদের অপচয় করা ছাড়া অন্য কোনোভাবে আখ্যায়িত করা যাবে না। তেমনি বড় বড় অবকাঠামো যেমন- রাস্তাঘাট বা ব্রিজ নির্মাণের পর যদি যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়, সম্প্রসারিত রাজস্বনীতি স্বল্পমেয়াদে যৌক্তিক বলে ধরে নেয়া যায়। কেননা, এ ধরনের ব্যয় দেশের সম্পদ, আয় ও ভবিষ্যত বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে বর্তমান অনির্বাচিত সরকার থেকে এটি আশা করা অবাস্তব। বর্তমানে বাংলাদেশে বড় বড় অবকাঠামোতে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে তার সাথে ভবিষ্যত আয় ও ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। বিনিয়োগের নামে বহু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে একমাত্র দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্য। এ ধরনের অপরিকল্পিত অতিরিক্ত ব্যয় দেশে মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির নির্দেশকগুলো একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে।
এটিকে নিতান্তই অবাঞ্ছিত বলে গণ্য করা উচিত। একই সাথে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশী ঋণ নেয়া ও ধীর গতিতে বাস্তবায়নের ফলে দেশের দায়-দেনা বেড়ে গেছে ও বিদেশের সাথে আর্থিক লেনদেনের দায়স্থিতিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তদুপরি সরকারের রাজস্ব নিধি হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের দায়িত্বহীন আর্থিক লেনদেনের সহযোগী হয়ে দেশের আর্থিক লেনদেনের সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর করে ফেলেছে। বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যার প্রধান কারণ হলো, সরকারের দলীয় রাজনীতি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে দলীয় লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা। সম্প্রসারিত রাজস্বনীতির মানেই হলো, সরকার আয় থেকে ব্যয় বেশি করবে। অতিরিক্ত ব্যয় করা মানে ঋণ নেয়া। এ ঋণ সরকার বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন পর্যায়ে, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে নিতে পারে। যেমনÑ ক. কেন্দ্রীয় ব্যাংক; খ. স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক; গ. জনগণ থেকে সরাসরি (সঞ্চয়পত্র); ঘ. বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংক (স্বল্প মেয়াদে); ঙ. সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান; চ. বহুজাতিক সংস্থা যেমন- বিশ্বব্যাংক, এডিবি; ও ছ. দেশে-বিদেশে সার্বভৌম বন্ড বিক্রি করার মাধ্যমে। তা ছাড়া বিদেশের সাথে আর্থিক লেনদেনের দায়-স্থিতিতে ভারসাম্য রক্ষা করার লক্ষ্যে আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে পারে। তবে সরকার যদি দেশীয় ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নেয় তাহলে অনিবার্যভাবে- ক. বেসরকারি খাতের সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতাদের পক্ষে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে; খ. সুদের হার বেড়ে যায়; গ. বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যায়; ঘ. ভোক্তারা ব্যয় সঙ্কোচ করতে বাধ্য হয়; ঙ. সরকারি দায়-দেনা অতিরিক্ত হারে বেড়ে যায়।
তবে সরকার ব্যাংকিং খাত ছাড়াও জনগণ থেকে সরাসরি ঋণ (ব্যাংক বহির্ভূত) সংগ্রহ করতে পারে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র, রাজস্বপত্র ও দীর্ঘমেয়াদি বন্ড বিক্রি করে। সরকার জনগণ থেকে সরাসরি ঋণ নিলে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ কমে যাবে। আবার এসব ঋণের ওপর সুদ বেশি দিতে হয়। তাতে সুদ ও আসল দু’টি একত্রে মিলে ভবিষ্যতে দেশের দেনা বেড়ে যায়। ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যায়। গত কয়েক বছরে সরকার দেশ-বিদেশ থেকে যে হারে ঋণ নিয়েছে তাতে দেশের ওপর ঋণ পরিশোধের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। ঋণের এই বোঝা বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বিদেশী ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণের সমস্যা : বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার বিদেশী ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে অনেক স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়েছে। সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ ধরনের ঋণ দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একই সাথে, বেসরকারি খাতকে বিদেশী মুদ্রায় ঋণ নিতে উৎসাহিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে; ১৯৭২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিদেশী মুদ্রায় বেসরকারি খাতে ঋণ ছিল ৩৫ কোটি ডলার। অথচ ২০১৩ থেকে শুরু করে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এসব ঋণ স্বল্পমেয়াদি ও সুদের হার উচ্চ। যখন ঋণ নিয়েছে তখন ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার ছিল ৮০ থেকে ৮৪ টাকা। বর্তমানে ডলার প্রতি ১১০ টাকা। অদূর ভবিষ্যতে টাকার অবমূল্যায়ন আরো বাড়বে। অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা যায়, বেশির ভাগ ঋণগ্রহীতা এ ঋণ ফেরত দিতে পারবে না বা সামর্থ্য নেই। পরিণতিতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। তবে ঋণগ্রহীতা দেশীয় মুদ্রায় ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করুক বা না করুক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এই ঋণ পরিশোধ করতেই হবে। অন্যথায় বাংলাদেশকে খেলাপি বলে গণ্য করা হবে। ঋণগ্রহীতা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেশীয় মুদ্রা পরিশোধ করলেও এই পরিমাণ টাকা ডলারে পরিশোধ করতে হবে। তাতে বিদেশের সাথে আর্থিক লেনদেন অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। টাকার আরো অবমূল্যায়ন হবে। মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। একই সাথে জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে। জীবনমানের আরো অবনতি হবে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বেসরকারি খাতকে বিদেশী ঋণ নিতে উৎসাহিত করার পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্বল্পমেয়াদে রিজার্ভ বাড়ানো। এসব বাণিজ্যিক ঋণের সুদ বেশি ও স্বল্পমেয়াদে পরিশোধ করতে হয় যা দেশের আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্য নষ্ট করে। এসবের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, দেশের অর্থনীতি আগের সরকারের চেয়ে এখন অনেক দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে- সেটি জাহির করা। এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু ভ্রান্ত নয়; বরং অনৈতিক। তাই এমন চাটুকারদের ভবিষ্যতে বিচারের সম্মুখীন করা উচিত। ওইসব ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে এখন সার্বিক আর্থিক লেনদেন হিসাবের মূলধন হিসাবে দিন দিন নিট অন্তঃপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। এসব ঋণের আরেকটি সমস্যা হলো- এ ধরনের ঋণ নেয়ার সাথে দুর্নীতি ও অপচয় বেড়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য, সরকার কর্তৃক বহুপাক্ষীয় প্রতিষ্ঠান যেমন- বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে গৃহীত ঋণের চেয়ে এসব ঋণের ব্যয় বহুগুণে বেশি। কেননা, আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক অর্থ প্রতিষ্ঠানের ঋণ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ও সুদের হার অনেক কম। ফলে স্বল্পমেয়াদের ব্যবধানে দায়-স্থিতিতে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় না; অর্থাৎ বিদেশের সাথে আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
বিদেশ থেকে এ ধরনের বাণিজ্যিক ঋণের ওপর সুদ পরিশোধের আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো- উচ্চ সুদ ও বিদেশী মুদ্রায় পরিশোধ করার কারণে জাতীয় সঞ্চয় কমে যায়। পক্ষান্তরে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ জাতীয় সঞ্চয়কে প্রভাবিত করে না। অতএব বিদেশী ঋণের ওপর সুদ পরিশোধের বিষয়টি উপেক্ষা করার নয়। কেননা, বিদেশে সুদ পরিশোধ বা লেনদেন বিদেশের সাথে আর্থিক দায়-স্থিতি পত্রের মূলধন হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। অতএব এসব ঋণ দেশের অর্থনীতির ঘাড়ে অতিরিক্ত গুরুভার ও বোঝা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যদি সরকার কোনো স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ বা সরবরাহকারীর ঋণ বা সার্বভৌম ঋণপত্র বিক্রির মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি ধার-কর্জ করে, তার পরিণতি ভবিষ্যতের জন্য অশুভ ও আত্মঘাতী হবে। এ ধরনের পরিণতিকে যদি উপেক্ষা করা হয়, সেটি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে আরো বিপন্ন করে তুলবে। বিদেশ থেকে ধার করা মূলধন ও বিনিয়োগ : সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত (বিদেশী ঋণ) মূলধন ও অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় হলো সার্বিক অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের মূল উৎস। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর জন্য মূলধনের যে চাহিদা, তা মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় যথেষ্ট নয়। অতএব দেশজ বিনিয়োগ ও দেশজ সঞ্চয়ের মধ্যে যে ব্যবধান, তার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনার জন্য বিদেশী বিনিয়োগের ভূমিকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, সার্বিক চাহিদার মন্থর গতি (slow GDP growth) ও সঞ্চয় হারের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির দুষ্টচক্র এড়ানোর সহজ রাস্তা হলো, বিদেশী বিনিয়োগ ও মূলধন আমদানি এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও সার্বিক চাহিদা বাড়ানো। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, বিদেশ থেকে ঋণ করে আনা মূলধন কার্যকরভাবে ব্যবহার করে দেশে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
আমদানিকৃত মূলধন উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশজ সঞ্চয়ের ঘাটতি পূরণ করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিদেশী মূলধনের যথার্থ বিনিয়োগ হলে দেশজ উৎপাদন বাড়ে, আমদানি কমে, রফতানি বাড়ে ও সার্বিক চাহিদা বাড়ে। দেশজ উৎপাদন বাড়লে আমদানি কমবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। রফতানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে বৈদেশিক দেনা শোধ করা যাবে। এর ফলে একদিকে বৈদেশিক দেনার ভার সহনীয় পর্যায়ে থাকবে, অন্য দিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বাস্তবিকপক্ষে, দ্রুত বর্ধিষ্ণু পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া- অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথম দিকে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিপুল বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছে।
তাতে অর্থনীতি দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। এসব ঋণ রফতানিমুখী শিল্পে বিনিয়োগের ফলে দায়দেনা ও রফতানির মধ্যকার আনুপাতিক হার বাড়েনি; বরং কোনো কোনো দেশে, যেমন কোরিয়ার বেলায় তা কমেছে। এর অর্থ হলো- প্রথম দিকে বৈদেশিক ঋণ বাড়লেও সাথে সাথে রফতানির হার বেড়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় বেড়েছে এবং ওই অতিরিক্ত রফতানি আয় দিয়ে ঋণ শোধ করে দিয়েছে। তাতে ক্রমান্বয়ে একদিকে বৈদেশিক দেনা (ঋণ) কমে গেছে ও পরের দিকে রফতানি আয় ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করেছে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে সহজে বলা যায়, দেশে বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই যার ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আপাতত স্থবির। কোনো আঙ্গিকেই বলা যাবে না, বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ বিনিয়োগবান্ধব। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে বিদেশী বিনিয়োগ আশা করা বাতুলতা মাত্র।
সঞ্চয়, মূলধন ও বিনিয়োগ : সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সাথে দেশে উৎপাদনের অবকাঠামো ও প্রযুক্তির কাঠামোগত উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন বৃদ্ধি ও ক্রমান্বয়ে মূলধন বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। সঞ্চয়ের হার এবং বিনিয়োগের প্রসার, বিস্তৃতি ও উৎকর্ষের সাথে জাতীয় সম্পদের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও জাতীয় আয়ের বিলিবণ্টনের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া জড়িত। এর কারণ, মানুষের এক এক স্তরের আয়ের সাথে তার সঞ্চয়ের প্রবণতা ও সামর্থ্য বদলাতে থাকে। আয়ের প্রতি স্তরে তাদের বিনিয়োগের আদর্শিক রীতি-নীতি একেক রকম। সবাই সঞ্চয় করতে চায়। তবে যে সব মানুষ চরম দারিদ্র্যে বাস করে তাদের জন্য সঞ্চয় করা খুবই কঠিন। যারা মাঝারি আয়ের মানুষ তাদের সঞ্চয়ের সামর্থ্য আনুপাতিক হারে বেশি। অন্য দিকে, উদ্যোক্তা শ্রেণী ও যারা সহজে ঝুঁকি নিতে পারে তারা এই সঞ্চয়ে বিনিয়োগ করে। তবে যে খাতে মুনাফা বেশি হবে ওইসব খাতে বিনিয়োগ করে।
এখানে উল্লেখ্য, আজকাল বহু স্বার্থান্বেষী টুকটাক ব্যবসায়ী (গোষ্ঠী) সাধারণত নীতিনির্ধারক, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে গোপন আঁতাত ও যোগসাজশের মাধ্যমে দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে ব্যবসায় করেন। এ ক্ষেত্রে অনেকে সেই ‘ঘুষকে’ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে। ঘুষ ও দুর্নীতিযুক্ত বিনিয়োগে আয় অতিমাত্রিক ও দ্রুত। এ ধরনের বিনিয়োগের বদৌলতে তারা অনৈতিক আয়ের সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতাও করায়ত্ত করতে পারে। ক্রমান্বয়ে তারা সেই ক্ষমতা কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করে আরো বেশি মাত্রায় এমনকি লাগামহীনভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ (গরিবের সম্পদ) চুরি ও লুটপাটে লিপ্ত হয়। এই লুটপাটের অর্থ বেশির ভাগই বিদেশে পাচার করে নিয়ে যায়। তাতে দেশ প্রথমে সঞ্চয় ও পরে বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়। বিনিয়োগ না বাড়লে উৎপাদন বাড়বে না, কর্মসংস্থান হবে না। তাতে মানুষ আরো গরিব হবে ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা আরো বাড়বে।
বিনিয়োগ ও আমদানিকৃত মূলধন : মোট অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ সবসময়েই মোট অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও আমদানিকৃত মূলধন, এ দুয়ের যোগফলের সমান। অবশ্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ব্যবধান দূর করতে বিদেশী মূলধন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেকোনো দেশ অভিমুখে প্রবাহিত হয় না। বিদেশী মূলধনের অন্তঃপ্রবাহ নির্ভর করে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, রাজনীতি, প্রতিযোগিতামূলক সুযোগ-সুবিধা ও অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করলে কী হারে মুনাফা পাওয়া যাবে, তার পার্থক্যের ওপর। যে দেশে মুনাফা বেশি হবে বাজারের সাধারণ নিয়মেই মূলধনের প্রবাহ সে দেশ অভিমুখে বেশি প্রবাহিত হবে।
বহুক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা উন্নয়নশীল দেশে তাদের বিনিয়োগ থেকে যতটুকু আয় হতে পারে সেটি হিসাব করার সময় প্রত্যাশিত আয় থেকে কিয়দংশ বাদ দিয়ে দেন। যে সব বিষয়কে ভিত্তি করে অনুমানমূলকভাবে কিছু অংশ তারা বাদ দেন সেসব বিষয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- বিনিয়োগকৃত দেশে ঝুঁকির পরিমাণ, বিদেশী উদ্যোক্তার কর্মতৎপরতা নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত বিধিবিধান, ওই দেশের সাথে বিদেশের আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্যে ও দায়-স্থিতির ভবিষ্যত, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, লেনদেনে অতিরিক্ত খরচ, শুল্কের হার, আয়করের হার, দুর্নীতির পরিমাণ, সে দেশে সম্পত্তি অধিকার আইন সমভাবে ও যথাযথ প্রয়োগ করা হয় কি না, মূল্যস্ফীতির হার, মুদ্রানীতি, মুদ্রার বিনিময় হারের বিশ্বাসযোগ্যতা, রাজস্বনীতি, পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, শাসনব্যবস্থা, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা, চুক্তি ভঙ্গে বিচারের দ্রুততা ইত্যাদি।
ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলোকে একত্রে ধর্তব্যে এনে বিনিয়াগকারীরা যোগ-বিয়োগ করে, বিনিয়োগের ঝুঁকি ও ভবিষ্যত আয় নির্ণয় করে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়- কোন দেশে, কোন খাতে বিনিয়োগ করবে। যে দেশে বিনিয়োগের ঝুঁকি বেশি মনে করে, সে দেশে মূলধনের প্রবাহ নিরুৎসাহিত হয়। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উপরোক্ত কারণগুলো বিদ্যমান থাকায় আজকাল বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। উপরোক্ত বিষয়গুলোর নেতিবাচক প্রভাব, শুধু যে বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে তা নয়; বরং দেশীয় বিনিয়োগকেও বাধাগ্রস্ত করে। ফলে একদিকে বিদেশী বিনিয়োগ আসে না, অন্য দিকে দেশীয় মূলধন বিদেশে পাচার হয়ে যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে আইনের শাসন অনুপস্থিত, আইনের অসম-বিষম প্রয়োগ, দুর্নীতি, লুটপাট ও আঁতাত, যোগসাজস ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশের নব্য ধনী (neo-rich) গোষ্ঠী তাদের বিনাকষ্টে অর্জিত টাকা-ধন-সম্পদ এখন বিদেশে বিনিয়োগ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ বা নিরাপদ মনে করে। তাতে মূলধনের বহিঃপ্রবাহ বেড়ে গেছে। সেই সাথে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ কমে গেছে। যদি অতিসত্বর উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলোকে সমাধান করে বিদেশ থেকে মূলধন আমদানির প্রবাহ বাড়ানো না যায় কিংবা দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের ব্যবধান দূর করতে না পারে, তাহলে দেশের আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর বর্তমানে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা দ্রুত বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছবে। সেই সাথে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে ও মুদ্রার মূল্যমান আরো কমে যাবে। এসব বিষয় আবার দেশের রাজস্ব ও মুদ্রানীতির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির সাথে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার ও শুল্ক ইত্যাদি সব মিলে দ্রব্যমূল্যের ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে। তাই বলা যায়, উভয় নীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই। বিগত দশকে বর্তমান সরকারের একচোখা ও একরোখা শাসন, অতিমাত্রায় দলীয়করণ, কুশাসন, স্বেচ্ছাচারিতা ও পরস্পরবিরোধী নীতি অনুসরণ করার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন, জাতীয় ঐকমত্য।
অর্থনীতির আকাশে কালো মেঘের ছায়া : অপ্রতিহত গতিতে দুর্নীতি, দুর্বল শাসন, আইনের অসম-বিষম প্রয়োগ, স্বজনপ্রীতি, প্রশাসনকে দলীয়করণ, মানুষের সব ধরনের অধিকার হরণ, আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাচারিতা ও গত দশকে একরোখা দলীয় রাজনীতির প্রাধান্যকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানোর আবেগ ও প্রবণতা, একরোখা অগণতান্ত্রিক নীতি ও কার্যক্রমে চরম দায়িত্বহীনভাবে মিশ্রিত ভুল এবং বিপরীতমুখী নীতির কারণে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির নিয়ামকগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এখন পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। এ কারণেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন- আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক এখন যেকোনো ঋণ অনুমোদনের আগে অর্থনীতির কাঠামোগত সমন্বয় সাধনের শর্ত জুড়ে দিতে বাধ্য হবে এবং তা পূরণে চাপ প্রয়োগ করবে। ফলে ভর্তুকি কমানোর জন্য জ্বালানির মূল্য ঘন ঘন বৃদ্ধি করতে হবে। একই সাথে, হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে স্বল্পকালীন সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য জ্বালানিনীতির ‘ভ্রান্ত ও মহাভুল’ সংশোধনকল্পে যেসব নীতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে, সেগুলো পালন করা সরকারের জন্য বেশ কঠিন হবে। তবে আইএমএফের শর্তানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। সরকারের এই ভুলের মাশুল জনগণকে কঠিনভাবে পরিশোধ করতে হবে।
বিদ্যমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা বিনাদ্বিধায় বলা যায়, বৈদেশিক লেনদেনের আর্থিক ভারসাম্য (balance of payment) আগামী বছরগুলোতে প্রচ- চাপের মধ্যেই থাকবে। অতএব দেশ ও জাতি মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হবে। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এমতাবস্থায় ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারকে আরো বেশি ঋণ নিতে হবে। যেহেতু ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারকে অতিরিক্ত মাত্রায় ঋণগ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে, সেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবশ্যই অর্থের জোগান বাড়াতে হবে। এমনকি অতিমাত্রায় টাকার নোট ছাপাবে। এতে করে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। বাণিজ্যিক ব্যংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট প্রকট হবে। সুদের হার বাড়তে থাকবে। তাতে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি উভয়ই বাড়তে থাকবে। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাবে। কারণ সরকার নিজেই বেশির ভাগ টাকা ঋণ হিসেবে নিয়ে যাবে। তাতে দেশে বেকারত্ব আরো বাড়বে। একই সাথে বিদেশী মুদ্রার বিপরীতে টাকার আরো অবমূল্যায়ন হবে বা মূল্যমান কমে যাবে। এর ফলে একদিকে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে ঋণের চাহিদা আরো বাড়বে এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে মূল্যস্ফীতি অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়তে থাকবে।
উপসংহার : অর্থনীতির বর্তমান সূচকগুলোকে বিশ্লেষণ করলে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না যে, এমতাবস্থা চলতে থাকলে- ক. আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তেই থাকবে, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি; খ. ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট বাড়বে; গ. সুদের হার বাড়তে থাকবে; ঘ. দায়-স্থিতি সঙ্কট বাড়বে এবং তীব্রতর হয়ে উঠবে; ঙ. দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ একান্তই ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে যাবে যার পরিসংখ্যানগত কোনো তাৎপর্য থাকবে না। ফলে বর্তমান বেকারত্বের উচ্চ পর্যায়ের হার থেকে পর্বতের চূড়ার দিকে উঠতে থাকবে; চ. দরিদ্র্যতার হার বেড়ে যাবে; ছ. সঞ্চয় কমে যাবে, ফলে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ আরো কমে যাবে; জ. বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ন্যূনতম শর্তের নিচে নেমে যাবে (আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী সাড়ে তিন মাসের পণ্য ও সার্ভিস আমদানি মূল্যের সমপরিমাণ থাকা বাঞ্ছনীয়); এবং জ. টাকার মূল্যমান আরো কমে যাবে। ফলে অর্থনীতির কাঠামোগত সমন্বয় কার্যক্রমে হাত দেয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। লেখক : এমএসসি, কৃষি অর্থনীতিবিদ, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন,সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই