মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের তৃতীয় দিন আজ শনিবার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই দিনটি ছিল একটি ঐতিহাসিক দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। একাত্তরের এ দিন থেকেই মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ হয় ভারতীয় মিত্রবাহিনী। সেই যুদ্ধ ক্রমেই সম্মুখ যুদ্ধের আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিন ফোর্ট ইউলিয়াম থেকে সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী চারদিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। নবম ডিভিশন এগোলা গরিবপুর, জগন্নাথপুর হয়ে যশোর-ঢাকা হাইওয়ের দিকে। চতুর্থ ডিভিশন মেহেরপুরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল ঝিনাইদহ-কালীগঞ্জের দিকে। বিংশতম ডিভিশন তার দায়িত্ব দু’ভাবে বিভক্ত করে নেয়। একটি অংশ থাকে হিলির দিকে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য, আরেকটি অংশ হিলিকে উত্তরে রেখে এগিয়ে চলে সামনে। এভাবে নানা ডিভিশনে বিভক্ত হয়ে চারদিক থেকে কার্যত ঘেরাও করে ফেলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। এদিন ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যৌথ-বাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এর পরদিন ৪ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে: (১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে; (২) উত্তরাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে; (৩) পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে; এবং (৪) মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আরেকটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে।
এদিন রাত ৯টার দিকে একটি অটার বিমান নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দু’জন চৌকস অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম (স্বাধীনতার পর দু’জনই সাহসিকতার জন্য বীরউত্তম খেতাব পান) দু’জন গানার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানি সংরক্ষণাগারে একের পর এক রকেট নিক্ষেপ করে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দেন। সাত ঘণ্টা সফল অভিযান চালিয়ে বিমান নিয়ে ভারতের কৈলা শহর বিমানবন্দরে ফিরে যান তারা।
যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানীরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড়ো করেছিল; যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। এর আগেই বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে পরাস্ত করে ঢাকার সকল সামরিক বিমান ঘাঁটির রানওয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়।
এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারসহ মুক্তিযোদ্ধারা ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সে স্বীকৃতি আসেনি। এদিন কলকাতায় রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ভাষণদানকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের এদিনে ফুলবাড়ী, লক্ষ্মীপুর, মতলব, দেবীদ্বার, ঝিনাইগাতি, কামালপুর, জীবননগর পাকিস্তান বাহিনী মুক্ত হয়। এ সব স্থানে উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের পতাকা।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে, “৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিটে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের ৭টি বিমান ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালায়। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় ছিলেন। তিনি দিল্লী ফিরেই রাত ১২টা ৩০ মিনিটে জাতিকে চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। জেনারেল অরোরা, পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান, আক্রমণের নির্দেশ দেন। চারদিক দিয়ে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।” ( গ্রন্থনা: ইবরাহীম খলিল )